Saturday, April 4, 2020

মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়

অনেকদিন চুপচাপ ছিলাম, বিভিন্ন কারণে। এক, আমার ছোটো পিসি চলে গেলেন কিছুদিন আগে, আকস্মিক সেরিব্রাল অ্যাটাক । কয়েকদিন আগেও কথা বলেছেন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে, খবরাখবর নিয়েছেন ... বলেছেন, 'অনেকদিন দেখিনা, একদিন আসো'! পিসেমশায় আমতার ইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, হেডমাস্টার মানুষ যেমন হয় তেমনি, পুরু ফ্রেমের চশমা পরা, চোখের সামনে হয় আনন্দবাজার না হলে পরীক্ষার খাতা ... আর পিসিমণি ছিলো নরম-সরম, আদরের মানুষ, ছোটোবেলায় আমি তাঁর ডাকনাম রেখেছিলাম গদীপিসি।
বাবার কাছে গল্প শুনেছি, বন্যায় সব ভেসে গেছে, আর বাবা, আমার মামাকে নিয়ে সঙ্গে মাথায় পোঁটলা বেঁধে প্রাণ হাতে করে পৌঁছেছেন ছোড়দির বাড়ি ... শুনেছি পিসেমশাইয়ের শখ হয়েছিলো ভোটে দাঁড়াবেন নির্দল প্রার্থী হয়ে, পিসিমণি নিজের গয়না বাঁধা রেখে টাকা তুলেছেন জামানত-এর ... সেই মানুষ-টা বোধ হয় হঠাৎ একটা পছন্দের স্টেশন দেখে জীবনের ট্রেন থেকে নেমেই পড়লেন সবাইকে ফেলে ! আর এমন-ই দুর্যোগের দিনকালে, যে আমার অশীতিপর পিসেমশাই শেষকৃত্য সেরে বাড়ি ফিরলেন যে লকডাউনের দিনগুলিতে, সেদিন তাঁর পাশে এসে বসার অনুমতি নেই কারুর ... হ্যাঁ, ভালোর জন্য-ই, জানি, কিন্তু সেই ছায়াঘেরা ছোটবেলার স্মৃতির বাড়িতে এখন 'আছে শুধু নেই' অগুন্তি মৃত্যুর মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে নিজের শোক বড়ো অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। তা হোক, ছোটোবেলায় যে তারস্বরে চেঁচিয়েছি সকাল সাতটার প্রেয়ারে ... 'মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়', তার কী কিছুই ফল পাবো না?
আর দুই, ব্যস্ততা ... জীবনের গভীর শোকের দিনগুলিতে কোনো কবিতা নয়, উক্তি নয় ... কাজ, কাজ, কাজ, পাগলের মত কাজ-ই আমাকে বারবার টেনে তুলেছে ... গত দুই সপ্তাহ, এই আরকান্সা রাজ্যের একদল লোক, কেউ পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট, কেউ এপিডেমিওলজিস্ট, একজন স্প্যাশিয়াল টেকনোলজি-র মহীরূহ, এঁরা সবাই মিলে দিন-রাত এক করে একটা দরকারী কাজ করছেন ! সবাই মিলে এনারা বোঝার চেষ্টা করছেন এই অঞ্চলের হাসপাতালের উপরে কতোটা চাপ পড়বে, কি করলে সেটা সামলানো যেতে পারে, ইত্যাদি ... সেখানে আমি যতটুকু পারি সাহায্য করছি, যা দু-পাতা পুস্তকস্থা তু যা বিদ্যা রয়ে গেছে তাই দিয়ে ! ( কতো লোকে যে এগিয়ে এসেছেন, কাঁধে-কাঁধ লাগিয়ে লড়ছেন, সেটা ভাবলে এই মৃত্যু উপত্যকার দাঁড়িয়েও ইচ্ছে করে একটা বড়ো শ্বাস নিতে ... খুব ভয় করে বাড়ির লোকেদের জন্য, পাগলের মতো ভয়, ভবিষ্যত ভয়ানক অনিশ্চিত মনে হয়। এই বিশাল মৃত্যুর মিছিলের বোঝা চেপে ধরে দশদিক থেকে... আর ধুলোর মধ্যে, খিদের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে হেঁটে যেতে যেতে সেই মিছিলের শিশুরা জিগ্যেস করে, লগ-স্কেলে আঁকবো, না লিনিয়ার? ... কিন্তু এই যে মোমবাতিটুকু কাঁপছে ঝোড়ো হাওয়ায়, এইটুকু দুই হাত দিয়ে আগলে রাখা দরকার ... যদ্দিন হাত দুখানা আছে ...

"ফলিবেই ফলিবে" ...



এই যে পাবলিক হেলথ-এর ' না জানা পাবলিক উদুম ডিপ লার্নিং আর কার্ভ ফিটিং করে রোজ সকাল-বিকেল দশটা কোভিড-১৯ ফোরকাস্টিং এর মডেল নামাচ্ছে, দৃশ্য দেখেই ইহজগত-কে টাটা করতে হবে মনে হচ্ছে !

যে দিকে জিনিষ যাচ্ছে তাতে অনিশ্চয়তা (আন্সার্টেনটি) কিছুদিন পরে উঠেই যাবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকান হবে মাতৃ মেশিনলার্নিং স্টোরস কিংবা বগলার ব্যাকপ্রপ কর্ণার, উপরে সাইনবোর্ড ঝুলবে সব জ্যোতিষী বারবার, ডিপ লার্নিং একবার” ...

সে যাই হোক, এই প্যানডেমিক মডেলিং-এর হিড়িক দেখে একটা সদ্য-যৌবনের গল্প মনে পড়ে গেলো! আমার আই-এস-আই-এর প্রাণের বন্ধু মাতাল (ভালো নাম গোপন থাকুক) তখন বিবাহযোগ্য ব্যাচেলর। বাড়ির লোকেও স্বাভাবিক ভাবেই উন্মুখ উদবিগ্ন ... তা মাতালের মায়ের সাথে একদিন বাজারে পুরোনো বান্ধবীর দেখা, -কথা-সে-কথায় জানা গেলো সেই বান্ধবীর- একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে, এবং সে মডেলিং করে। মাতালের মা হাতে চাঁদ পেলেন, বললেন বাঃ আমার ছেলেও তো সারাদিন মডেলিং- করে ...

শোনা যায়, নির্দিষ্ট দিনে এরপর দুজনের দেখাও হয়েছিলো বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে, কিন্তু মডেলার মডেলকে দেখতে না দেখতেই মডেলার মাতালের মা বলে ওঠেন, না রে বাবা তোর দ্বারা হবে না ...

আজকের এই মডেলার-দের যদিও সেরম কিচ্ছু বলতে চাই না একেবারেই, এটা নিছক-ই একটা গপ্পো!





পুনশ্চ ১ - কেউ ভুল বুঝবেন না, আমার মনে হয় ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি কাজ না করলে এরকম সাংঘাতিক প্যান্ডেমিক রোখা সম্ভব নয়, অথবা পরের বারের জন্য প্রস্তুত হওয়াও খুব খুব শক্ত ... তবে একটা বীভৎস পাবলিক হেলথ ক্রাইসিসের আগাপাশতলা না বুঝে এই ঘোলা জলে একটি খ্যাপলা জাল রেডি রাখার চেষ্টা, অথবা নিজের দু-পহার কোডিং স্কিল শো-অফ করা যে কতখানি crass এবং বিপজ্জনক, সে বোধ কিছু ডেটা-চচ্চড়ির হলে ভারি খুশি হই এই আর কি!

হ্যাঁ, এই বাজারে বরং ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট নিয়ে এট্টু পড়ে নিন (যার মোদ্দা কথা হচ্ছে যে লোকের নিজেদের বিদ্যে-বুদ্ধির দৌড়, তাদের নিজেদেরই সচরাচর বোধগম্য হয় না!

পুনশ্চ আমার সব গল্প- অতিরঞ্জিত (নাহয় নির্জলা আর্বান লিজেন্ড)এটাও ব্যতিক্রম নয়তবে একটু রঙ না চড়ালে জীবন বড়োই মান্ডেন ...


Monday, February 17, 2020

কেন?


A crowd flowed over London Bridge, so many,. I had not thought death had undone so many. 


এক-একদিন মনে হয় এই যে একটা বাচ্চা পুঁচকি কুকুরছানা আমার গন্ধ শুঁকে শুঁকে  খুঁজে বেড়াবে আর ওকে কেউ-ই কোনোদিন বুঝিয়ে বলতে পারবে না কিছুই,
সেই জন্য,
আমার মা এই যে রোজ ঠাকুর-ঘরে পুজো দিতে দিতে ভাবেন ঠাকুর এইবারে - এইবারে মুখ তুলে তাকাবেন এই সংসারের উপর, সেই শেষ পুজোর কারণটুকু কেড়ে নিতে ইচ্ছে করে না,
সেই জন্য,
একদিন একটা বন্ধু হয়তো ভুলে যেতে-যেতেও, হঠাৎ ফিরে এসে বলবে 'চ' একটা কাউন্টার খাই', তার সাথে একটা সিগারেট অনেক চুম্বনের থেকেও দামী ছিলো,

সেই জন্য ...

আর আমাদের সোনাঝুরির জন্য ...

একদিন এই জলের দাগ, কাশির শব্দ, আর শেকলের আওয়াজ শুনে শুনে সে পথ চিনে এখানে আসবেই আসবে, হাতে একটা নোংরা পুতুল নিয়ে

হয়তো সেই জন্যেও ...



(কৈফিয়তঃ- 'কেন?' অর্থাৎ এই যে আমি হেঁটে যাচ্ছি, এক ব্যর্থতা থেকে আরো গভীরতর ব্যর্থতার দিকে, কেন? আমি বারংবার নিজের কাছে ফিরে আসি, নিজের বেড়ে চলা ক্ষতের কাছে অসহায় দু-দন্ড বসি, আর দুই হাত দিয়ে প্রাণপণে কান চেপে শুন্যতার অসহ্য শব্দ থেকে নিজেকে বাঁচাই ... তবুও কেউ ঠিক কানে কানে জিগ্যেস করেই চলে, "কেন?")

১৭-ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০

Sunday, July 16, 2017

ট্রেনের গল্প



লীলা মজুমদার লিখেছিলেন, গল্প হয় ভূতের, নয় চোরের, নয় বাঘের নয় ট্রেনের ... তা আমার এ ইহজীবনে খাঁচার বাইরে বাঘ দেখার সৌভাগ্য হয়নি, আর শোনা সব বাঘের গল্পেই গরু আছে, কাজেই সেসব এখন মুলতুবি ...  তবে চোর আর ভূত দেখেছি গণ্ডা গন্ডা, আমাদের ওদিকে তো নাইটগার্ড বলে কিছু হয় না, সিঁধকাটা আর স্কন্ধকাটারাই দেখেশুনে রাখে। ওরাই ছাতে মাদুর পেতে ঘুমোয়, রাত্রে পাড়া টহল দেয়, ব্যানার্জীদের রকে বসে আড্ডা মারে, তিনপাত্তি খেলে - তবে হুট করে কাছে গেলেই তারা মিলিয়ে যায়, দু-একটা পোড়া বিড়ির টুকরো আর খালি ঠোঙা উড়ে বেড়ায় মৃদু বাতাসে ...

তা এই রকের আড্ডায় যা দারুণ সমস্ত গল্প শুনেছি, বলবো একদিন, একটু রাত্তির করে বেশ জমিয়ে বসে, একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ... তবে উত্তর কলকাতার ভুত তো, ভয়-টয়ের কারবারে নেই, বরং বেশীর ভাগই বেশ লাজুক এবং নিতান্ত ছাপোষা ... এই যেমন এক জেঠুমানুষ ছিলেন পাড়ায়, সাত্ত্বিক প্রকৃতির, মাঝে মাঝেই এসে গাঁটের ব্যাথার জন্য একদাগ আর্ণিকা আর আমাশার জন্যে অ্যালোজ নিয়ে যেতেন। বাবার কাছে শুনেছি জেঠ্যু সাধনোচিত ধামে পাকাপাকি চলে যাবার পরেও মাঝে মাঝে সকালে উদয় হতেন চেম্বারে, বাজারের লঙ্কা থেকে লাউ কেমন আগুন দাম বলে গজগজ করে দুই পুরিয়া ওষুধ নিয়ে চলে যেতেন ... অব্যেস তো, ডাই হার্ড ...

এই অব্দি পড়ে যদি ভেবেছেন যে ভর-সন্ধ্যায় ভুতের গল্প ফেঁদে বসেছি, ভুল করছেন ... এটা আসলে ট্রেনের গল্প । আমার বাবা নেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথ, পেশায় রেল-কর্মচারী - বছরে দু-দুটো পাশ পেতেন আর আমরা পুজোর ছুটি, শীতের ছুটি দেদার ঘুরে বেড়াতাম এদিক-ওদিক। প্রায়ই প্ল্যান শুরু হতো পুষ্কর লেক দিয়ে, শেষ হতো পাশের পাড়ায় পুরীর বীচে ... কখনো আবার হঠাৎ করে দেখতাম একগাদা কিচিরমিচির করা ফ্যামিলি নিয়ে চলেছি পাহাড়ে বা সমুদ্রে। ইস্কুল থেকে কলেজে উঠে তো আরো মজা, ফি বচ্ছর শিক্ষামূলক ভ্রমণ হয়, একজন অসহায় টিচার, আর একগাদা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। আমাদের সেই ছোটো আর মাঝারি-বেলার সব গরমের ছুটি যদি একটা আঁতেল আর্ট ফিলিম হয়, তার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হবে শুধুই কু-ঝিক-ঝিক এবং ফাঁকে ফাঁকে 'চায়ে গ্রম চায়ে' ...

হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়তো বেশ রাত্তিরে, আর বাড়ি থেকে স্টেশন যাওয়াই এক ঝকমারি কান্ড, ধরুন যাবেন বেনারস, মেরে কেটে ষোলো-সতেরো ঘন্টা - তার জন্য খাবার প্যাক হবে চার দফা, লুচি-আলুর দমের সঙ্গে মিষ্টি, মাঝে মাঝে উসখুস করলে চানাচুর, দু-একটা ফল-টল তো এম্নি-ই চলে আসে। ঘুম থেকে যখন উঠতাম সকালে, আপার বার্থ থেকেই দেখতাম বাইরের মাঠের রঙ পালটে গেছে, সবুজ ফিকে হচ্ছে, আস্তে আস্তে ধূসর, মাঝে মাঝে সেই ভুষুন্ডির মাঠের ঠিক মধ্যিখানে একটা করে টেলিফোনের বা ইলেক্ট্রিসিটির টাওয়ার, বলা-নেই-কওয়া-নেই দু-একটা টানেল আসে হঠাৎ হঠাৎ করে... আর শহরতলি পেরোতে পেরোতে লেভেল ক্রসিং, ব্যস্ত মানুষ-গরুতে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি তাদের টা-টা করতে করতে চললেন হলিডে হোমে ...

বাবার কল্যাণে ফার্স্ট ক্লাসে উঠতে পেতাম, দরজা দেওয়া আলাদা কেবিন, বাথরুম থেকে  দিরে এসে দেখবেন না উটকো লোকে উঠে জায়গা নিয়ে গেঁড়ে বসে আছে, তবে জার্নিও নেহাৎই অ্যাডভেঞ্চার-হীন, সে এসি টু-টায়ারে স্বামী ঘুটঘুটানন্দও উঠবেন না যোগসর্পের হাঁড়ি নিয়ে, সামনের বেঞ্চি থেকে জটায়ুও হঠাৎ বলে উঠবেন না , 'এখানে রোদের তেজ-ই আলাদা, সাধে কি আর লোকগুলো এতো পাওয়ারফুল?' ... দূরপাল্লার ট্রেনে রেলের ক্যান্টিন থেকে খাবার আনানো হতো, সেসব অখাইদ্য খাবার কিন্তু ওই থালা গুলোর ওপর হেব্বি লোভ ছিলো, সুন্দর খাপ কাটা-কাটা ...

দামড়া বয়সে বন্ধুদের সাথে যাওয়ার সময় তো গোটা ট্রেন জার্নি-ই পেটের উপর কুজ্ঝটিকা ! একবার ঠিক হলো, হাওড়া-টু-দিল্লী প্রত্যেকটা স্টেশনে পুরি-তরকারি খেয়ে বেস্ট পুরি ঠিক হবে ভোটাভুটি করে, আরেকবার ঠিক হলো কোথাকার ঝালমুড়িতে কত ঝাল না জানলে জীবনটাই বৃথা ... (এক দাদা আবার ঝালমুড়িতে ঝাল না পেয়ে আরেক আলুকাবলিওলা-র কাছে একটা কাঁচা লঙ্কা ধার চেয়েছিলো, বলেছিল ফেরার ট্রেনেও তো উনি-ই আবার উঠবেন, তখন না হয় একটা কাঁচা লঙ্কা ফেরত দিয়ে দেবে।)

সব গল্পেই একটা না একটা ভিলেন থাকলে জমে না, আমাদের ট্রেনের গল্পের ভয়ের মুখোস পরে থেকে থেকে হানা দিতো টিটিই-রা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবার হাতে টিকিট দেখে তবে ছাড়, একটু এদিক-ওদিক হলেই ... বাঘে ছুঁলে যদি আঠারো, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ... টিটিই ছুঁলে কত হয় তা যাঁরা টের পেয়েছেন সে হতভাগারাই জানেন ... এই যেমন আমি ...

আমাদের কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, গোয়া যাওয়া হবে, এক্কেবারে শিক্ষামূলক ট্যুর ... যাওয়ার আগের দিন ভোররাত্রে জানা গেলো কোনো এক মহাপুরুষ গোটা কলেজের গ্রূপ টিকিট ঝেঁপে দিয়ে আম্বানি হয়ে গেছে ... এদিক আমাদের সমবেত পুচ্ছে হালকা করে হাম্পু ! কিন্তু সে নতুন জওয়ানির জোশ, একবার ছাড়া পেলে ধরা মুশকিল, ঠিক হলো ট্রেনে উঠে পড়া হবে, তারপর ম্যানেজ দেওয়া যাবে। সে যা জম্পেশ ট্রেন জার্নি হয়েছিলো, র‍্যামসে ব্রাদারকেও হার মানায়, দমবন্ধ সাস্পেন্সের মাঝে নতুন নতুন রিউমার, কেউ বলছে দুটো স্টেশন পরে রেল্পুলিশ দাঁড়িয়ে  হাতকড়া গুনছে, কিন্তু এতো বিশাল গ্যাং বলে হয়তো কোমরে দড়ি-ই নিয়তি, আশাবাদীরা খবর আনছে কোন সিনিয়রের বাবা নাকি কোন মিনিস্টারের খাস বন্ধুর পাশের ফ্ল্যাটেই পার্টি করে , গায়ে হাত দিলেই একটা ফোন, গোটা রেল কোম্পানি উঠে যাবে ... (শেষমেশ কি করে পৌঁছেছিলাম, ঠিক জানিনা, আজ-ও) ...

তবে এক মাঘে শীত যায় না, বিশেষ করে বাঙ্গালীর তো নয়-ই ... দিল্লী থেকে ট্রেনিং শেষে ফেরার দিন, বন্ধুরা জোরকদমে প্যাক করছে, আমি জানি আমার টিকিট পরের দিন, আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের টিকি(ট)-ও আমার জিম্মায়, আজ রাত্রে বরং সাঁটিয়ে রাজিন্দর ধাবায় তন্দুরি খাওয়া যাক ... পরের দিন পূর্বা এক্সপ্রেস ধরতে যখন স্টেশানে পৌঁছলাম, পানু জিগ্যেস করলো, "টাইমটা ঠিক দেখেছিস তো? সাড়ে চারটে?" ... আমি পকেট থেকে টিকিট বের করে দেখি হ্যাঁ টাইম-এ ভুল হয়নি, ট্রেনটা একদিন আগেই ছেড়ে চলে গেছে । ভাগ্যি দুজনের পকেটে মিলিয়ে অল্প টাকা ছিলো, টিটি এসে জেনারেল ক্লাসে তুলে দিলো ... বাথ্রুমের পাশে, লোকে হিসি করছে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে, আর দরজার বাইরে পা ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছি আমরা ...

ব্যাপারটা রোম্যান্টিক ভাবছেন? আদৌ না ... এই ধরুন যাচ্ছেন মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে, আগের কামরার ফ্যামিলির ডিনার শেষ হলো ... হঠাৎ বসে বসে দেখবেন একের পর এক মিসাইলের মতো এটোঁ পাতা আর প্লাস্টিক জানলা থেকে ধেয়ে আসছে আপনার দিকে, অনেক ডজ করে যাও বা সে পুষ্পবৃষ্টি এড়ালেন, শুরু হলো কুল্কুচি করা জলের বন্যা ... পানু ছেলেবেলায় যোগাসন আর জিম্ন্যাস্টিক, দুয়েই চ্যাম্পিয়ন ছিলো - হঠাৎ এক অপোগন্ড কুচো আর তার বাপ-মা সভয়ে দেখলো, রাতের অন্ধকারে পূর্বার জানলার শিকের বাইরে দিয়ে একটা ভয়াবহ রোদে পোড়া , দাড়িয়াল মুন্ডু, সে বাংলা-মেশানো হিন্দিতে শাসাচ্ছে ; ফির সে জানলা দিয়ে কচড়া ফেঁকলে তার গুষ্টি কি তুষ্টি ... আমার বিশ্বাস স্বচ্ছ ভারত অভিযানের প্রথম সেনানী সে-ই ... আমার বন্ধু পানু ...

আর ভয় ছিলো রেল-গার্ডদের, বিশেষ করে যদি বিড়ির নেশা থাকে, দরজার কাছে গিয়ে এক বন্ধু খাবে আর আরেকজন গার্ড দেবে দেখার জন্য কেউ আসছে কিনা ... কেউ কেউ আরেকটু কড়া বিপ্লবী, কাউকে কিছু না বলে ঢুকে পড়তো বাথ্রুমে ... এইরকম-ই একজন ছিলো মাতাল, মনের আনন্দে সিগারেটে শেষ টান টা দিয়ে যেই বেরোবে, দ্যাখে বাইরে রেলের গার্ড হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। মাতলু-ও চুঁচড়োর খুনখার আদমি, হাত তুলে বললো, "কই সিগারেট কিধার? সার্চ কিজিয়ে ! " রেল গার্ড দেখলো বিপ্লবীর উত্তোলিত হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা এক-প্যাকেট দেশলাই !

স্লিপার-ক্লাসে হরদম উঠতো নানারকমের খাবার-দাবার, আর উঠতো অনেক অনেক টিকিট-ছাড়া যাত্রী, এক কোণে টুক করে বসে পড়ে তাঁরা সমাধি লাভ করতেন - তারপর যাই জিগ্যেস করুন, "কোথায় যাবেন? সিট কোথায়? মামার বাড়ী পায়া হ্যায় ক্যায়া?" - সবের-ই উত্তর সেই এক, নির্বিকার নৈঃশব্দ ! সে এক তুমুল ক্যেওস ... হঠাৎ সবাই দেখলো ট্রেনের সব কামরায় হইচই, খালি মাঝে একটি আশ্চর্য মরূদ্যান ! জানা গেলো সেই কামরায় যাতায়াত করছেন আমাদের আরেক দাদা, যার অনেক অতিমানবিক ক্ষমতার মধ্যে একটি হচ্ছে যোজনগন্ধী পায়ের মোজা ... যেখানে তিনি শ্রীচরণকমল দুখানি ন্যস্ত করতেন, কয়েক মাইলের মধ্যে মশা-মাছিরাও টুপটাপ মরে ঝরে পড়তো আকাশ থেকে ... তারপর থেকে কতবার যে তিনি বিপদভঞ্জন হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন দুর্ভ্যেদ্য জঙ্গল থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেস, শুনলে লোকনাথ বাবাও নতুন চাকরি খুঁজবেন ...

লিখতে লিখতেই অনেক ভাবলাম, নাঃ আমার শেষ দূরপাল্লার ট্রেনজার্নি সেই দিল্লী টু হাওড়া, বাথ্রুমের পাশে মেঝেতেই ... এদিক-ওদিক খুচরোগুলো বাদ দিলে ... আর মনে পড়লো, আমার সেই বন্ধুর এক ছাত্রের কথা ... তার বাবা-মাও আমাদের লাইনের, অঙ্ক কষে জীবন কাটিয়েছেন, ছেলেকেও সেইদিকেই ঠেলাঠেলি করতেন ... আমাদের ট্রেন-কাহিনী যখন লোকের মুখে মুখে ফিরছে, ছেলেটি সাহস পেয়ে বাবা-মা কে গিয়ে বললো, 'দেখেছো তো সারাজীবন গাঁতিয়ে অঙ্ক করলে কি দশা হয়? আমি বরং ফিজিক্সটাই মন দিয়ে পড়ি' ...


Saturday, March 11, 2017

রঙ-রুটের বাস



শিকড়-বাকড় প্রায় সব-ই ছিঁড়ে গেছে অনেকদিন হলো, তাও পলিটিক্স আর পপুলেশন বৃদ্ধির বাইরেও এককালে একটু-আধটু খবর রাখতাম, আর কিছু না হোক কবে কি পালা-পার্বণ হচ্ছে ্সেটা ঠিক জেনেই যেতাম - হঠাৎ আজ সকালে ফেসবুক  খুলে জানতে পারলাম দেশজুড়ে দোল হচ্ছে .. শুনেই এই প্যাচপেচে বৃষ্টির দিনে মনটা আরেকটু স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেলো ...

এ পোড়া দ্যাশে ভাঙ-টাঙ পাওয়ার তো কোনো আশাই নেই, উদ্যমী দেশোয়ালি ভাই-বেরাদরদের দেখা পাওয়াও মির‍্যাকলের সমতূল্য, কাজে এক্কাপ কফি খেয়েই চোখ বুজে কল্পনা করে ফেললাম খানিক। পষ্ট দেখলাম চারদিকে রংজলে ভরা বেলুন ছুটছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতন, কিছু হনুমান রঙ মাখা ছেলেপিলে জামা কাপড় ফর্দাফাঁই করে হিংস্র উল্লাসে লাফাচ্ছে - আমার আবার ভায়োলেন্স পোষায় না, তাই মাঠের এককোণে একটা থান ইঁটে মাথা দিয়ে দিব্য নাক ডাকাচ্ছি ... আর পাশে কোনো এক সদ্য প্রেম সেরে ওঠা কিশোর, ভারি দুঃখের সাথে ধানাইপানাই করছে, সিদ্ধিলাভ মনে হচ্ছে আর বেশী দূরে নেই ...

অবিশ্যি ছোটোবেলায় দোল ব্যাপারটা আদৌ হোলি ছিলো না আমাদের বাড়িতে, বাবা-মা কচি বয়সেই ঘোষণা করে দিলেন, দোল মানে বড়োজোর গুরুজনদের পায়ে অল্প একটু এবং বিনিময়ে মাথায় আরো কম আবির - এবং বেসরকারী কারফিউ, রাস্তায় ওৎ পেতে কারা যেনো বসে আছে, বেরোলেই নর্দমার জলে চুবিয়ে বাড়ি পাঠাবে ... পরেরদিন স্কুলে গেলে দেখতাম এক ক্লাস পরিষ্কার করুণ মুখের মাঝে কয়েক জোড়া লাল-রঙা কান আর বিজয়ীর হাসি, টিচারের বকুনি খেয়ে চওড়া থেকে চওড়াতর হচ্ছে সেগুলো - সেই নিষ্পাপ নব্বুইয়ের সেইগুলোই ছিলো আসল প্রতিবিপ্লব ...

আমারও সহজেই সময় এসে গেলো, পাড়ায় মাঠের বন্ধুরা বললো - পরের দোলে আমায় বাঁদুরে রঙ মাখানোর দায়িত্ব গোটা জামরুলতলার। বাবা প্রথমে নর্দমার জলের ভয় দেখালেন, তারপর বুঝলেন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী আইসক্রিম, পেপসি সবতেই নর্দমার ভয় টেনে এনে ব্যাপারটাকে ধর্মঘটের মতোই অকেজো করে ফেলেছে, তারপর বললেন বেলুন মারলে লাগবে, তাতে বললাম তাহলে শুদ্ধু বড়োদের দিকেই ছুঁড়বো - শেষমেশ বললেন জোর করে সিদ্ধি-ভাঙ খাইয়ে দিতে পারে, বলেই বুঝলেন জোরটোর লাগবে না, সেসব দৈব প্রসাদের প্রতি জন্ম থেকেই আমার অবিচল ভক্তি ...

তারপর থেকেই দোলের মানে হুট করে পালটে গেলো - সেই সকালে মা একটা পুরোনো টিশার্ট বের করে দিতেন গজরগজর করতে করতে, আমরা কয়েকজন এপাড়া ওপাড়া ঘুরে দস্তুরমতন গোটা এলাকায় দোলের ধাত এবং জাত নিয়ে রিসার্চ করে বাড়ি ফিরতাম বেলা গড়িয়ে - বাবা তখন খ্যাপা টাইসনের মতন রিঙে পায়চারি করছেন, বাড়ি ঢুকলেই হুক-পুল-জ্যাব মেরে সোজা কলতলায় - আমার কুছ পরোয়া নেই, পরের দিন স্কুলে গিয়ে আমিও গল্প বলবো -- সাঁতরাপাড়ায় কেমন পাবলিকের চান করার জায়গাটায় রঙীন চৌবাচ্চা বানিয়েছিলো, মাম্পির বাবা কেমন বাড়ির বাগানে লুকিয়ে রেখেছিলেম পাড়ার নেড়ী-ন্যাড়াদের, রঙের থেকে বাঁচাতে - আর শেষে বলবো সেরাটা,  পেয়ারাবাগানের গলিতে আমার আর আমার বন্ধুর মাথায় ছাদ থেকে বালতিভর্তি জল ঢেলে দিলো একটি মেয়ে, "পালিয়ে যাওয়ার আগে একবার চোখাচুখি" - দোলের গল্পেও রঙ না চড়ালে আর কিসে চড়াবো, বলুন?

তবে নাঃ, সিদ্ধি-টিদ্ধি কেউ দিতো না, সেই কলেজে যাওয়া অব্দি দোল এক্কেবারে মাটিতেই কেটেছে ... কলেজে তো এলাহি ভরোসা, মেসের টেবিলে বিশাল বিশাল গামলায় মেসের কালিদা-বংশীদারাই বানিয়ে রাখতো অমৃতের শরবত, আ-হা ! তার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা এই খাগের কলমে অন্ততঃ নেই - তবে হ্যাঁ, যা যা ম্যাজিক দেখতাম ভোলবার নয় ...

এক দোর্দন্ডপ্রতাপ জুনিয়র ছিলো, জেজে, চট করে তার পা বা মাথা টলে না, হরলিক্স পার্টিতে হাফ-ছাদ যখন মৃদুমন্দ মলয় বাতাসে উড়ে বেড়ায় ইধার-উধার, জেজে তখন মন দিয়ে এটাসেটামিক্স করে বা নিপুণ দক্ষতায় পথভোলা পথিকদের পৌঁছে দেয় নিজ নিকেতনে ... একবার দোলের দুপুরবেলা, সেই জেজে, আমি, আরো কয়েক ঘোর পাপী বসে আছি মেসের মাঝখানে গোল করে, আর এক বন্ধু যাকে রাঙানোও যায়নি, ভাঙানোও যায়নি ... হঠাৎ সবাই বুঝলো কেউ-ই প্রায় ঘন্টাখানেক কোনো কথা বলছে না, খালি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে বেড়ালের মতন হেসেই চলেছে - থামার নাম নেই , আর সেই একজনের বদ্ধমূল ধারণা সবাই তার উপরেই হাসছে, কিন্তু কেন কেউ জানেনা... একটু পর জেজে প্রথম কথা বললো, 'বুঝলে, সিদ্ধি হচ্ছে অনেকটা ইথার তরঙ্গের মতন, যারা খেয়েছে সবাই কানেক্টে্‌ড, বাকিরা সিগন্যাল ধরার লোভে অ্যান্টেনা বাড়িয়ে আছে, কিন্তু ক্লিয়ার পিকচার আসছে না' ...

সেদিন বাড়ি ফেরার সময় ফাঁকা মিনিবাসে উঠে জেজে দুটো টিকিট চেয়েছিলো, কন্ডাক্টর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকায় একটু পরে বলেছিলো, কেনো একটা আমার, একটা আমার ব্যাগের !

আমি দুপুরে বাড়ি ফেরার রিস্ক-ই নিইনি, সন্ধ্যেবেলায় হঠাৎ একটা ফোন আসে, এক পোটেনশিয়াল ছাত্রীর, অঙ্ক শিখতে চায়, তাদের বাড়ি গেছি, সন্দেশ-শরবৎ সাজিয়ে দিয়েছে, আমার এদিকে প্লেটে হাত দিয়েই মনে হলো অনেকদিন ক্যারম খেলা হয়নি, একটা গোলপানা কড়াপাকের মিষ্টিকে স্ট্রাইকার বানিয়ে একটা ইঞ্চি শট অনেকক্ষ্ণ ধরে মেপে যাচ্ছি - হঠাৎ পর্দার ওপার থেকে দয়ালু কাকিমার গলা ভেসে এলো, 'বেশী অঙ্ক-টঙ্ক করলে না এরকম হয়ে যায়, আমার মেয়েটাকে বরং ডাক্তারিটাই পড়িয়ো বুঝলে?' ...

আরেকবার দোলের সন্ধ্যেয় পূর্ণিমার চাঁদটাকে তাড়া করে করে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম আমি আর এক বন্ধু মিলে, ঠিক করেছিলাম সেই রাত্তিরে গোটা উত্তর কলকাতার সবকটা চায়ের দোকান ঘুরে চা খেয়ে ঠিক করবো কার চা সবচাইতে ভালো - কোথায় কোথায় ঘুরেছিলাম সেটা আর মনে নেই, তবে সেরা চায়ের দোকানটা মনে আছে আবছা - একটা উঁচু রেললাইনের জমি, তার তলার একটা গুমটি ঘরে একটা দিদু চা বানায় কেরোসিনের স্টোভে ...

লিখতে-লিখতেই মনে পড়লো সেদিন সন্ধ্যেবেলাও ঠিক এমনি টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিলো সারাক্ষণ, ভিজতে ভিজতে একটু হাঁটা, আবার ছাঁট দেখলে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ... বুড়ি দিদুর দোকানে কেউ আসেনি সেদিন ... অনেকক্ষ্ণ গল্প করেছিলাম ... বাড়ি ফিরে সেদিন আয়নায় দেখেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজে রঙ আর নেশা দুটোই ফিকে হয়ে গেছে একদম ...

তারপর আর খেলিনি, নাঃ ... খুব বৈরাগ্য টাইপের এসে গেলো ... কোলাহল আর ভালো লাগতো না, ফাঁক পেলেই ছুটে শান্তিনিকেতন চলে যেতাম, বসন্তোৎসব মনে হতো স্বপ্নের মতো, সকালবেলায় "ওরে গৃহবাসী"-র সাথে গলা মেলাতে মেলাতে অবাক হয়ে দেখছি ফাগুন হাওয়ায় উড়ন্ত গুলাল, মনে মনে কোথাও ওই হলুদ-লালের দলে মিশে যেতে চাইছি আমিও, দলে ভিড়ে দুপুরবেলা যাচ্ছি কঙ্কালিতলার মাঠ, বিকেলের দিকে কি কোপাই ? ... হয়তো সে আর এক জন্মের কথা, ওই কোপাইয়ের মাঠেই হয়তো বসে আছি ... গলা বেয়ে গান উঠছে আজ, বন্ধুরা সারি সারি সাইকেল গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে রেখেছে আর মাদল বাজছে জ্যোৎস্নার চরাচরে, সবাই নাচছে আগুনকে ঘিরে ...

কখনো ভাবতাম নাঃ, অনেক দূরে কোথাও অন্য কোনো দেশে যেন জন্মেছি আমি, বৃদ্ধ হয়েছি লেখার পিছনে ছুটে ছুটে... জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বরফে ঢাকা ঝাউগাছের তলায় বাচ্চারা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আমি ধূমায়িত কফির কাপের পাশে টাইপরাইটারের সামনে পরের প্লটটা ভাবছি ...

যেন সেই স্বপ্নের মধ্যেই জেগে উঠলাম আজ, বাইরে এখনো সেই অঝোর বৃষ্টি, সেই ধূসর আকাশ, তার মাঝে খানিক শিল পড়লো যেনো টুপ্টাপ করে, গিন্নীমশাই কফির কাপে শিল ধরতে গিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা খেয়ে পালিয়ে এলেন, এখন আমার চারপেয়ে ছানা মেচকু সারা পাড়াকে কীর্তনগান শুনিয়ে তেনার কোলে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে আর স্বপ্নে খরগোশ আর কাঠবেড়ালী তাড়া করে যাচ্ছে প্রাণপণ .. লেখা শেষ করেই ওদের শোনাবো, তারপর দারুণ এককাপ চা আর সিঙ্গারা ! কে বলেছে আরকানসায় দোল আসে না?



Tuesday, December 6, 2016

নিকানো উঠোনে ঝরে রোদ


(বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ এই গল্পের সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক, মনগড়া, আজগুবি এটসেটেরা। আসলে বাংলা মিডিয়ামের ছেলেরা আদৌ আমার মতন ল্যাদাভ্যারুস না, বরং অনেক স্মার্ট হয় ! কাউকে কাউকে দেখে, সত্যি বলছি, একচুলও বোঝা যায় না ! ঠিক তেমনি এটা যদিও তর্কের খাতিরে মেনেও নিই যে সব ট্যাঁশই ইংলিশ মিডিয়াম, আপনাকে-আমাকে আর মদন-মামাকে মানতেই হবে যে সব ইংলিশ মিডিয়াম-ই ট্যাঁশ নয়! 

আর না মোটেও লজ্জা-টজ্জা পাই না, বরং বিশ্বাস করি বাংলাভাষা আমার উত্তরাধিকার, অস্বস্তিকর জন্মদাগ নয় - তবে আলিমুদ্দিনও একদিনে 'জাঙ্গিয়া পড়েনি, আর কথাঞ্জলিও রাতারাতি লেখা হয়নি ! বাইরে যখন বৃষ্টি ছিলো, তখন অনেক পাতা এদিক ওদিক গাছ-গাছালি, কূট-কচালি, বাপের খ্যাদানি আর প্রেমের প্যাঁদানিতে ভরিয়েছিলাম আমরা ! জলে ভিজে, উইয়ে ধরে সব নষ্ট হয়ে যাওয়ার আগে দেখি যদি একটুও উদ্ধার করা যায় - এই শীতের মিঠেকড়া রোদ্দুরে আচারের বয়ামের পাশে অমনি কয়েকটা পাতা ! যেরকম পেলাম তেমনি রেখে দিলাম পাশাপাশি, কেমন?)


তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে ?
আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে ...

তো সেটা কত সাল আমার মনে নেই, এটা মনে আছে যে কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত তখন ওপেন করতেন আর ক্যামন নাক-ফাক কুঁচকে এদিক-উদিক চার-ছয় হাঁকাতেন। এইসময়েই একদিন আমার বাবা এসে থার্ড আম্পায়ারের মতন আউট ঘোষণা করে জিজ্ঞেস করলেন, "সারাদিন যে হাঁ করে টিভি গিলছো, কি হবে বড় হয়ে?" আমিও সপাটে স্টেপ আউট করে বললাম, "ওই যে শ্রীকান্ত"! বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, 'ম্যান অব দ্য ম্যাচের ইন্টারভিউটা দেখেছো? কির'ম সুন্দর ইংরেজি বলছে? পারবে?' আমি বিপদ বুঝে বললাম, 'ঠিকাছে, তা'লে কপিল দেব' ... বাবা কিয়ৎকাল রণে ভঙ্গ দিলেন বটে, কিন্তু আমি বুঝলাম সত্যি ঘোর বিপদ ... নিশীথস্যার বেত হাতে যে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন শুরু করেছেন, এ জীবনে তা বোধকরি আর ঘোচার নয় !

এখানে একটা কথা বলে রাখা দরকার, আমার বাবা নেহাৎ দিনে রেলে চাকরি আর রাতে ব্রাইয়োনিয়া-বেলাডোনা করে ইহজীবন কাটিয়ে দিলেন বটে, আসলে কিন্তু ওনার মধ্যে হাল্কা করে একটা ত্রিকালজ্ঞ ব্যাপার ছিলো, অন্ততঃ আমাকে নিয়ে - যখন যা ভয় পেতেন, মাস খানেকের মধ্যে 'ফলিবেই ফলিবে' !

এবারেও তার ব্যত্যয় হলো না ! নিশীথদা একগাদা ট্রান্সলেশান দিলেন পরীক্ষায়, আর আমিও তো বাংলার বাঘ ! কোসচেন দিলো, 'আমি রোজ ভাত খাই', আমি ভেবে দেখলাম eat বললে তো খাই মনেই হয়, কিন্তু এই যে আমি রোজ রোজ শুধুই ভাত-ই খাই, রোজ ম্যাগি নয়, রোজ বিরিয়ানি নয়, যেন অনন্তকাল ধরে সিসিফাসের পাথর তোলার মতন প্রতিবাদ না করে শুধুই ভাত-ই খেয়ে যাচ্ছি, সেটা কি শুধু eat বললে মেটে? নাঃ ! দীর্ঘশ্বাস ফেলে লিখে দিলাম 'I eats rice'!

খাতা বেরুলো যেদিন, দেখি ভদ্রলোক সবার উপরে আমারটা নিয়ে এসেছেন, ক্লাসে পড়ে শোনাবেন বলে ... পাক্কা পনেরো মিনিট নিশীথদা আর সেকশান-ডি হ্যাহ্যা করে হাসলো, আমিও মনে মনে বেশ পুলক অনুভব করলাম, কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখি আবহাওয়া থমথমে, বাবার হাতে একটা লাল বই, রেন অ্যান্ড মার্টিন, আর চেয়ারে একজন পুরুষ্টু গোঁফওয়ালা নতুন মাস্টারমশাই !

মাস্টারমশাইয়ের জেদ ছিলো সাংঘাতিক, আমাকে তিনি দেখলেন যেন অমল দত্ত দেখছেন রেলিগেশানের মুখে মোহনবাগান ! কি-ই না করতেন, মাঝে মাঝে ইংরেজি কাগজ ঠুসে বলতেন পড়ে যাও একপাতা, আমিও নিকুচি করেছে বলে প্যারা-ফ্যারা উড়িয়ে কংগ্রেস-ডায়ানা-হাওয়ালা-আজহার সব একসাথে পড়ে যেতাম! মাঝে মাঝে পাশে তাকিয়ে দেখতাম দিদি হাসি চাপতে ইতিহাসের বইতে মুখ লুকোচ্ছে আর বাবার ভ্রূ শুয়োঁপোকা থেকে শুয়োঁপোকা-তর হচ্ছে ক্রমশঃ ...

রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলেছিলো বহুদিন, এবং কবে কি করে যে সেই মাস্টারমশাই শেষমেশ রণে ভঙ্গ দিয়ে পালালেন তা আর মনে নেই এক্কেবারেই, তবে শাপে বর হলো সত্যি - যাঁকে পেলাম, তাঁকে ইংরেজির টিচার বলা মানে রবীন্দ্রনাথকে ট্রাফিক পুলিশ বলা ! তিনি দেখলেন একে দিয়ে গ্রামার-ট্রামার হবে না, এর পাস্ট অতিশয় ইনডেফিনিট, ফিউচার ততোধিক টেন্স ! হাতে ধরিয়ে দিলেন দুটি বই, অস্কার ওয়াইল্ডের পিকচার অব ডোরিয়ান গ্রে আর টি এস ইলিয়টের কবিতাগুচ্ছ! ইংরেজি একফোঁটা বলতে বা দু-কলম লিখতে না পারলেও যে দিব্যি পড়ে মুগ্ধ হওয়া যায় ... সেটা সেই জানলাম !

বছর দেখতে দেখতে ঘুরে যায়, নরেন্দ্রপুরে ঢুকে দেখলাম, সব বই ইংরেজি হয়ে গেছে - ভয়ানক চাপ ! শুধু কেকুলের সাপ বুঝলে চলবে না, সে সাপ ছোটে না কি হাঁটে না, অন্ততঃ বাংলায় চাটে না ... একবার কেমিস্ট্রির ল্যাবে কি কান্ড, ঢুকে দেখি সারি সারি শিশিবোতল - গায়ে বড় বড় করে লেখা INFLAMMABLE ! এদিকে তো রেন অ্য্যান্ড মার্টিন গাঁতিয়েছি, in মানেই নঞর্থক ! এই যেমন ধরুন ঃ

incapable - আমার মতন অপদার্থ,
inaudible - মিনমিনিয়ে কতা কয়, কেউ শুনতে পায় না,
incurable - যা সারে না, শাহ্রুখখানের তোতলামো, আর আমার ক্যাবলামো,
invisible - যা দেখা যায় না, গাঙ্গুলীর কভার ড্রাইভ !
infallible - যা একবার উঠলে আর পড়ে না (এটার উপমা আর দিলাম না) ...

তো আমিও মনের আনন্দে ঠাউরে নিয়েছি, ইনফ্লেমেবল নিশ্চয়ই হিন্দু আত্মার মতন অদাহ্য - অক্লেদ্য কিছু একটা হবে, আমিও এটাসেটামিক্স করবো বলে দুটো বোতল হাতে নিয়ে পিছন ফিরেছি - দেখি দীনবন্ধু স্যার ভয়ার্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে !

এইবেলাই বুঝলাম, জানেন, যে জীবনে এমন কিছু পড়াই ভালো, যেখানে খুব বেশি ইঞ্জিরি না মাড়িয়ে পাতার পর গ্রীক লেটার আর চাউমিন সিম্বল দিয়ে ভরিয়ে দিলেও দিব্যি চলে যাবে ... টুক করে স্ট্যাটে চলে এলাম ... আই-এস-আই-তে বছর পাঁচেক আমার ইংরেজি ওই পিসি-র অমর কবিতার মতন,
"তোমার নাম? হ্যালো হাই / বাবার নাম? সি ইউ বাই!" 

তখন বাংলা শুধুই রন্ধ্রে নয়, রক্তেও ! এক রোববার GRE দিয়েই ছুটতে ছুটতে আমি আর পানু চলে গেলাম খালাসিটোলায় ! হাফ ওপেন স্কাই ছাদের তলায় স্কুলবেঞ্চ পাতা, একদিকে বাংলা বিক্রি হচ্ছে ঢেলে, একদিকে মাছভাজা-আলুকাবলি, আর খালি বোতল ফেরৎ দিলে তিন টাকা সাতাত্তর পয়সা !
সে অন্ধকারে মাটির ভাঁড়ে প্রেম-অপ্রেম যেন গলে জল হয়ে এলো ! এক চুমুক দিয়েই দেখলাম বিকেলের আকাশে সবকটা মুখ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেলো - হঠাৎ পানু বললে, ভেবে দ্যাখ জেডি, কমল্কুমার ক্লাসের ফাঁকে এসে এক পাত্তর ঢেলে গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন এককোণে, বা হয়তো তুষার রায় সদ্য লেখা কবিতাটা শোনাচ্ছেন শক্তি-সুনীলদের ! ফেরার সময় মনে আছে, ট্যাক্সিকাকুকে কিছুতেই মনে করে বলতে পারছি না কোথায় নামতে চাই, পানু অনেক কষ্টে বললো, নর্থ ক্যালকাটা ! 

জীবনটা চলে যাচ্ছিলো, দিব্যি চলেই যেতো, পাঁচ বছর যে আসলে ইনফিনিটি নয় সেটা কেউ বললেও বিশ্বাস করতাম না  - কিন্তু তাও, কলকাতা থেকে মুম্বাই, মুম্বাই থেকে আবার পালাতে পালাতে অর্ধেক পৃথিবী দূরে, দিন-রাতের অন্যদিকটায় !

'পড়ে রইলো যে, পড়েই থাকতো ... সে লেখা তুলবে বলে, 
কবি ডুবে মরে, কবি ভেসে যায় অলকানন্দা জলে ...'

বলেছিলাম এখন লজ্জা পাই না, তখন কিন্তু খুব হতো ... খু-উ-ব, বলে আর শেষ হওয়ার নয় সে গপ্পো ঃ একদিন সাবওয়ের কাউন্টারে দাঁড়িয়ে বলেই যাচ্ছি বাবা দুটো পেয়াঁজ আর লঙ্কা দে, ব্যাটা হাঁ করে তাকিয়ে আছে যেন অর্জুন বিশ্বরূপ দর্শন করছে ... আরেকদিন আবার হলে ঢুকে সবাইকে জিজ্ঞেস করছি ভাই লিফটটা কোনদিকে, তারা এমন ভাব করছে যেন আপনি শ্যালদা স্টেশানে পক্ষীরাজ ঘোড়া খুঁজতে বেরিয়েছেন ... অনেক কষ্টে একদিন ঘন্টা দেড়েক ধস্তাধস্তি করে এক ব্যাটাকে বানান করে বোঝালাম যে আমার জীবন ইন্টারনেট ছাড়া অচল, সে পরেরদিন দরজায় প্যাকেট রেখে পালিয়ে গেলো, উপরে নাম লেখা 'Jyoeis Daha' ..

তারপর তো কত-কত-দিন গড়িয়ে গেছে, দিকে দিগন্তরে বক্তিমে দিয়েছি, ছাত্রদের বুঝিয়েছি কোরিলেশান আসলে কজেশান নয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে একটা দুরুদুরু যায়নি পুরোপুরি - সেই প্রথমবার যখন আইনক্সে অ্যানাকোন্ডা দেখতে ঢুকে বুঝেছিলাম হলের সিনেমায় শালারা সাবটাইটেল দেয় না, আর নিতান্ত বাধ্য হয়েই শুধু লোপেজ দিদিকে দেখেই ফিরে এসেছিলাম - সেরকম অনেকটা ! এখনও আগে পুরো বাক্যটা মনে ভেবে নিই, তারপর ভাবি নিশীথস্যার ক্যালাবে, তারপর ট্রান্সলেট করি,  একটু হি-শি-হ্যাজ-হ্যাভ দেখে টেখে নিয়ে বলি - ভুল্টুলও কমে, লোকেও নির্ঘাৎ একটা গ্রাম্ভারি গেছোদাদা টাইপের কিছু একটা ভেবে নেয় !!

তবে হারাতে হারাতেও, ভেসে যেতে যেতেও, শ্যাওলা-খড়কুটো ধরে কি করে যেন একটু সেই খালাসিটোলার সন্ধ্যেটা রয়ে গেছে গ্লাসের তলায় লেগে ! অঙ্ক-টঙ্ক যেদিন নামে না, বা যেদিন খুব ইচ্ছে করে দাঁড়ে বসে ডানা ঝাপটাতে, সেদিন খাতা খুলে একটা বাতি জ্বালিয়ে বসি ... এক বন্ধুর দেওয়া ফাউন্টেন পেনটা যত্ন করে পরিষ্কার করে কালি ভরে একটু লিখি একটা সাদা পাতায় ... হয়তো একটা প্রিয় শব্দ, একটা আদরের নাম ... একটা চেনা কবিতা মাথায় আসে, গুনগুন করে,

' তবু সে এখনও মুখ 
দেখে চমকায়
এখনও সে মাটি পেলে 
প্রতিমা বানায়' 

আস্তে আস্তে জটগুলো ছেড়ে যায় তখন ! এই বন্ধ পড়ার ঘরের ঘুলঘুলি আর আনাচ কানাচ দিয়ে কি করে যেন ক্যাট-ব্যাট-ডগ-ফিশ পেরিয়ে ঢুকে পড়ে একরাশ বাংলা ভাষা ! পরম মমতায় আমার হাতের আঙ্গুল ছুঁয়ে থাকে সে ... আমি আবার স্বপ্ন দেখি !

Sunday, November 20, 2016

তেজেনবাবুর গল্প


                                                                    <১>


তেজেনবাবুর মনমেজাজটা একদম-ই ভালো নেই আজ, এই শীতের সকালে গিন্নির তাড়া খেয়ে যাও বা বাজারে গেলেন, দু-একপিস রোগা ফুলকপির বাচ্চা আর জলডোবা পটল ছাড়া কিছুই পেলেন না, মাছের বাজারে ঢুকে মনে হলো সেদিন বেশী দূরে নেই যে মানুষ ব্যাগভর্তি পয়সা নিয়ে বেরুবে আর পকেটে ভরে বাজার নিয়ে বাড়ি ফিরবে, সামনের মাসে আবার বাবার বাৎসরিক, ভেবেই পেটটা একটু বকমবকম করে উঠলো যেন ! পৌনে একঘন্টা অকারণ দর-দাম করে একজোড়া বিষণ্ণ মাগুরমাছ আর পেয়াঁজকলি নিয়ে বাড়ির চৌকাঠ ডিঙ্গোতেই টের পেলেন টুবাই-টিকলু আবার পড়াশোনা থামিয়ে টিভিটা চালিয়েছে, আর পাশের বাড়ির অবিনাশবাবুও এই সক্কালবেলাই দাঁত মেজে দাদু-গেঞ্জি পরে চলে এসেছেন - চা খেয়ে, টেলিগ্রাফ পড়ে তারপর কালকের ম্যাচ আর কেন্দ্রীয় সরকারের বঞ্চনার বেত্তান্ত নিয়ে ঝাড়া একটি ঘন্টা এখন বরবাদ ... নাঃ, সকালগুলো বড্ড বিরক্তিকর লাগে আজকাল ...

গতকাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটা একটা করে ঝুলপি থেকে পাকা চুল কুচকুচ করে কাটছিলেন তেজেনবাবু, হঠাৎ খেয়াল করলেন আয়নার লোকটার দিকে - মনে হলো যেন ভুরু কুঁচকে থাকতে থাকতে কপালের মাঝখানটায় অল্প ভাঁজ-ই পড়ে গেছে, আর যাওয়ার নয় ... আয়না দিয়ে বসার ঘরের দেওয়ালে ঝোলা বাবার সেপিয়া-কালারের ছবিটাও ভালো করে ঠাহর করে দেখে নিলেন একবার। হ্যাঁ, সেই অব্যর্থ কূঞ্চন, কপালের মাঝখান বরাবর যেনো ইন্ডিয়ানা আর গন্ডোয়ানাল্যান্ডের ঠোকাঠুকি লেগে একটা আস্ত হিমালয় উঠছে, ঠিক তলায় এক জোড়া চোখ, ভিসুভিয়াসের থেকেও ভয়ঙ্কর... চোখগুলোর দিকে চেয়ে এই এগারো মাস পরেও বুকটা অল্প কেঁপে গেলো তেজেন্দ্রনারায়ণ বাবুর ... আবার কাঁচি-ঝুলপি তে মন দিলেন আবার।


টুবাইটা ঘর থেকে উঁকি মারলো একবার, খবরের কাগজটা নেওয়ার লোভে, আজকেই সিনেমার পাতাটা দেয় - বাবার থমথমে মুখ দেখেই আবার সুড়সুড় করে লেজ গুটিয়ে ঘরে ঢুকে গেলো। মাঝে মাঝে নিজের ছেলেদের দেখলে নিজের-ই অল্প আফশোস হয় আজকাল, চেয়েছিলেন কড়া ডিসিপ্লিনে ছেলেদুটো মানুষের মত মানুষ হবে, অঙ্ক করবে তো রামানুজন, ব্যাট হাতে মাঠে নামবে তো সেওয়াগ ... হলো তো ঘোড়ার ডিম, এ দুটোয় অঙ্ক করে সেওয়াগ আর ব্যাট করে যেন চোখ বুজে ত্রৈরাশিক কষছে। মাঝখান থেকে বাবার সাথে বন্ধুত্বটা হলো না কোনোদিন-ই ... এক-একদিন অফিস থেকে বেরুতে বেরুতে মনে হয় যাই বাড়ি ফিরে গল্প-গাছা করি, তারপর সেই সার্কুলার রেলের ভিড় আর মেট্রোর সামনে হনুমানের ল্যাজের মতো লম্বা লাইন পেরোতে পেরোতে কোথায় যে ইচ্ছেটা উবে যায় ...

অফিসের নেতাইবাবু রোজ-ই আসেন টিফিন-টাইমে, রেলে কাজ করেও ভদ্রলোক সাইড বিজনেস চালিয়ে যাচ্ছেন এই বয়সেও। সেই অ্যামওয়ের পিরামিড স্কিম, কে যে কার মাথায় ইঁট চাপাচ্ছে কেউ জানে না  - কেউ ডাকেও না তাকে, তাও এসে এই চেয়ার, ওই চেয়ার ঘুরে নিজেই খানিক বকবক করে যান রোজ ... আজও তেজেনবাবু চেয়ারটায় দোল খেতে খেতে ঝুলপিটায় হাত বোলাচ্ছিলেন লাঞ্চের পর, হঠাৎ দিগন্তে বত্রিশ পাটি ঝকঝক করে উঠলো দেখে বুঝলেন নেতাইবাবু ... ধপ করে চেয়ারটার নিজেকে ফেলে দিয়ে নেতাই বললেন,

" বুইলেন না মহায়, আপনার নামটাই কালপ্রিট ! তেজেন্দ্রনারায়ণ ! শুনলেই কেমন একটা ইয়ে হয় না?"
"আপনার তো কিছুই হয় বলে বোধ হচ্ছে না"
"আহা, আমি তো সাতঘাটের জল খাওয়া মানুষ, কিন্তু এই যে ডেঁপো বাচ্চারা, সারাক্ষণ তাস পিটছে, একবার আপনি করিডরটায় হেঁটে দেখুন গে, ওমনি আড্ডা থামিয়ে টকাটক এক্সেল খুলে বসবে"
"ভয় পায়, পেতেই পারে"
"ভয় না ভায়া, টেরর টেরর, লিফটে ওঠা-নামার সময় কাউকে দেখেছো কোনোদিন? দ্যাখোনি! তুমি ভায়া লিফটের দিকে হেঁটে গেলে আনকোরা জুনিয়র-রাও সাততলা সিঁড়ি বেয়ে নামে, জানো?"
"ধুর! যত্তসব ... ওরা চেনেই না আমাকে"
"সে আর চিনতে কি লাগে, তুমিই ভেবে বলো দিকি যার নাম তেজেন্দ্রনারায়ণ - সে লোকটা কোনোদিন তুড়ি মেরে শিস দিয়ে গান গেয়ে উঠবে, বা খুব আড্ডা মারবে রকে বসে?"

তেজেনবাবুর মনটা বড়োই খারাপ হয়ে গেলো - সবাই ভয় পায়, সব্বাই? কয়লাঘাটের রেলের অফিসের পাশেই মিলেনিয়াম পার্ক, জানলা দিয়ে অনেকক্ষণ সেইদিকেই তাকিয়ে থাকলেন - বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরা স্কুল কেটে হাত ধরে ঘরে বেড়াচ্ছে, কি মজা ওদের ! তেজেন-ও কি ওইরকম-ই ছিলেন এককালে?

ছোটো ছেলে তিনি, চার ভাইবোনের মধ্যে - মা একটু বেশীই স্নেহ করতেন, আর বাবা পুষিয়ে দিতেন পিঠে কঞ্চির বাড়ি মেরে ... আর ভাইবোনগুলো বেশ প্রতিভাবান - বড়-দা ডাক্তার, মেজ-দাও দারুণ অঙ্ক কষতেন, এখন বাইরে, আর বড়দি-ও সেকালের ডাবল এম-এ, চাট্টিখানি কথা নয়, একটা নাকি ক্যাসেটও ছিলো, তিনি যদিও পৃথিবীর মায়া কাটিয়েছেন বাবার-ও আগেই - বাবা বলতেন "মেন্ডেলিয়ান জেনেটিকস, পেডিগ্রি, পেডিগ্রি, সবটাই পেডিগ্রি" ... তিনি ছিলেনও এক মহাপুরুষ - ছেলেবেলায় ফুটবল খেলেছেন তো এক্কেবারে ফার্স্ট ডিভিশান, পাহাড় চড়েছেন তো বেস ক্যাম্প, আবার নাকি নিজের লেখা বই-ও ছিলো একটা ... ছেলে হিসেবে তেজেন এক্কেবারেই ডাহা ফেল! গোদের ওপর বিষফোঁড়া - বাৎসরিকে বাবার উপর দুচার লাইন বলার জোয়াল-টাও তার কাঁধে ফেলে বড়দা গেছেন, মেজদার কাছে বেড়াতে ...

তেজেন-এর সত্যি বলতে পড়াশুনোয় একটুও মন ছিল না। দুপুরে সবাই ঘুমোলেই পকেটে গামছা নিয়ে পাশের পুকুর, বা কোনোদিন বাবার লুঙ্গি চুরি করে জামরুল গাছের ডগায় ... প্রেমে পড়ার পরে একটা ডায়রিতে কয়েক লাইন চেষ্টা করেছিলো সে, ভালো কিছু নামেনি, বাপের বাজখাঁই গলার আওয়াজে বোধহয় কাব্যলক্ষ্মী তাদের পাড়া দিয়ে যাননি খুব বেশীদিন ... তবে ফেল-ও সে করেনি কোনোদিন, সকাল নটার বনগাঁ লোকালে যেমন প্রত্যেক স্টেশানেই ঝুলতে ঝুলতেও ঠিক আরেকটা লোক উঠেই যায়, তেজেনও তেমনি বেতের বাড়ি খেতে খেতেই বছর বছর ডিঙিয়ে যেতো ক্লাসের গন্ডি ...

ট্যালেন্ট অবিশ্যি তার-ও একটা ছিলো বটে, সেটা হচ্ছে অনর্গল ঢপ মারা - কাজে এবং অকাজে। পরীক্ষায় পঁচিশ পেলে বাড়ি এসে বলতো হায়েস্ট উঠেছে সাতাশ, ছাতা হারিয়ে গেলে সটান বলে দিতো চোখের সামনে চুরি হয়ে গেলো ধরতে পারলাম না  ... এমনকি পাড়ার বুড়িপিসি যেই জিগ্যেস করতেন, 'তেজেন, মুদির দোকান চললি?' ... তেজেন না ভেবেই বেমালুম বলে দিতো, 'না পিসি, রেশনে লাইন দিতে' ...

যেখানে বাপের ভয়, সেখানে সন্দ হয় ... বাবাও ছিলেন একেবারে সত্যবাদী চরকা, থেকে থেকেই ধরা পড়ে যেতো মিথ্যে আর কপালে জুটতো বেধড়ক পিটুনি ... ভেবেই এই শীতের দুপুরে এসি ঘরে বসেও গেঞ্জির ভেতর হালকা ঘেমে উঠলেন তিনি, ফাইলটা বন্ধ করে বার দুয়েক পায়চারি করলেন গোটা অফিসটা - তারপর চারটে বাজতেই ফোন করলেন স্কুলের বন্ধু খ্যাঁদা-কে ! আজকে আর বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে হলো না ছ'টার ভিড়ে মারামারি করে, একটু গল্পগাছা করে-ই ফিরবেন আজকে ...
                                            
                                                                    <২>

"কনস্টিপেশান, বুঝলি, কন্সটিপেশান", সিগারেট টাকে টোকা মেরে গঙ্গার হাওয়ার উড়িয়ে দিয়ে বললো খ্যাঁদা !
"রাক্ষসদেরও হয়? জানতাম না"
"না না, আমার না - এমনি বাঙালী জাতির ... ওই কনস্টিপেশানে ভুগেই গেলো, এই তুই যেমন"
"বাজে বকিস না তো... আমার আজ --"
"আঃ শোন না, এটা মেন্টাল ... এই যে তোর ভেতর যে আরেকটা তেজেন, তারও ইচ্ছে করে, বাইরে বেরুই, একটু আড়মোড়া ভেঙ্গে সন্ধ্যের হাওয়া খেয়ে বাড়ি ফিরি? তাকে যে গত চল্লিশটা বছর আটকেই রাখলি খাঁচায়, কিছু লাভ হলো? ... ভেবে দ্যাখ একবার !"

                                                                      <৩>

ফিরতে ফিরতে ন-টাই বেজে গেলো তেজেন্দ্রনারায়ণের । কয়েক-কাপ চা সিগারেট পেয়ে মনটা আজকে বেশ ফুরফুরা শরীফ বোধ হচ্ছে । গিন্নির নাক পুরো ব্লাডহাউন্ড, ঢুকতেই  হাত থেকে টিফিন বাক্স নিতে নিতে বললেন,
"এই যে বললে ছেড়ে দিয়েছো?"
"আর বলো না, লালগোলা লোকাল তো, কোনটা প্যাসেঞ্জার - কোনটা ভেন্ডার বোঝা যায় না, পাশের একটা দিলখুস-ওয়ালা যাচ্ছিলো, গোটা রাস্তাটা বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে গেলো"

গিন্নিও জেরা থামিয়ে টুবাই-টিকলুকে পড়া ধরতে চলে গেলেন। তেজেন-বাবুর মনে হলো শোয়েব আখতারের বলে আলতো খোঁচা দিয়ে উইকেট-কিপার, স্লিপ গলে যেন একটা বাউন্ডারি মারলেন তিনি ... বসার ঘরে ঢুকেই দেখলেন আবার অবিনাশবাবু, সকালের পড়া কাগজটাই পড়ছেন আরেক রাউন্ড চা ধ্বংস করতে করতে,

"হেঁ হেঁ, খুব লেট যে আজকে, খুব খাটাচ্ছে না রেল কোম্পানি? তা আর নতুন লাইন তো আর পাতছে না বাবা, খাটায় কেনো কে জানে? ... আচ্ছা আমার ওই রিজার্ভেশানটা? পারলেন নাকি একটা ম্যানেজ করতে ... দাদা- বৌদিকে কিন্তু কথা দিয়েছি"
"নাঃ মশাই, টিকিটটা এবার হলো না আর বুঝলেন? আসল খবর তো আর পড়েন না, এদিকে আন্দামানে ভল্ক্যানো-টা জেগে উঠেছে আর পুরীর সমুদ্রে নাকি হাঙর বেরিয়েছে ! তা-ই এবার পুজোয় ঝেঁটিয়ে সব বাঙালী ডাল-লেক ... এতো আগে থেকে কেটে ফেলেছে যে এবার বাথরুমে আপার-বার্থ -লোয়ার বার্থ লাগাতে হবে, আপনি বরং মুকুটমণিপুরটা ট্রাই করে ফেলুন "

অবিনাশবাবুর চুপসে যাওয়া মুখটাকে দেখতে দেখতে এবার সত্যি তেজেনবাবুর মনে হলো একটু হাততালি দিয়ে নেচে নেবেন, যেনো স্টেপ আউট করে স্টুয়ার্ট ব্রডকে ছয় মারলেন গাঙ্গুলী ... অনেকদিন পরে একটা হিন্দি গানের লাইন-ও মাথায় কোন কুঠরি থেকে বেরিয়ে পড়লো, তেজেনবাবু ঠিক করলেন, নাঃ টুবাই-টিকলুকে আজকে আর অ্য্যালজেব্রা না করিয়ে গল্পই শোনাবেন বরং ... বাৎসরিকের স্পিচটারও আইডিয়া আসছে মাথায় !

                                                                           <৪>

"থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ... অবিনাশবাবু এবারে একটু বসুন, এই টুবাই দেখতো কলিংবেল বাজালো কে? টিকলু মা-কে দেখো তো কি লাগবে? ...

আপনারা যে এতোসবের মধ্যেও এসেছেন ... কি বলবো, খুব-ই একটা আনন্দের ব্যাপার, বাবা বেঁচে থাকলে ... অবশ্য তিনি থাকলে কি আর বাৎসরিক করতাম ... যাই হোক, বাবাকে যাঁরা চেনেন অনেকদিন - তাঁরা তো সব-ই জানেন, তা-ও দু-চারটে কথা বলবো আজকে...

আমার বাবা, রাজেন্দ্রনারায়ণ, সারা জীবন ইস্কুলে পড়িয়েছেন, কিন্তু শুধুই মাস্টার ভাবলে ভুল হবে! আমার বাবা ছিলেন একাধারে অনেক, তিনি ছিলেন ফুটবলার, পর্বতারোহী, আবার রীতিমতো প্রকাশিত হওয়া লেখক-ও ...এক-ই অঙ্গে এতো রূপ যাকে বলে !

যখন ফুটবল খেলতে নেমেছেন, ভারতবর্ষ তখনও পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ, বাবা বললেন, নেটিভ রেফারী না দিলে টিম মাঠেই নামবে না - তার সাহস ছিলো, ইংরেজ শাসক মেনে নিলো, আবার যখন পাহাড়ে চড়েছেন, মাইনাস টেন-এ পাহাড় চড়ে পৌঁছেছেন অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্পে - সেখানে কত দেশের লোকের সাথে আলাপ ছিলো, পেন ফ্রেন্ড ছিলেন অনেক ফরেনারের ... সেসব চিঠি আছে এই বাড়ির-ই কোথাও !
ফিরে এসে বই-ও লিখেছেন চাকরি করতে করতে, কিন্তু লজ্জার কথা, সে বই পড়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি ... জন্মের আগেই লাস্ট কপিটাও হারিয়ে গেছে কোথায় কেউ জানেনা ...

আমি সে তুলনায় নিতান্তই সাদামাটা ছাপোষা একজন কেরানী, কোনো দাগ-ই কাটতে পারিনি ... কিন্তু আশা রাখি বাবা, তার কাজের দৌলতে আপনাদের মনে চিরজাগরূক থাকুন"


                                                                       <৫>

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি-ই হলো একটু তেজেনবাবুর, বড্ড ধকল এক-একটা ফাংশান ! উঠে দেখলেন সকাল দশটা দশ, গিন্নি টুবাই-টিকলুকে নিয়ে কোচিং ক্লাসে চলে গেছেন - সত্যি বাচ্চাগুলোর রোববার বলেও কিছু নেই ! কিচেনে একটা উলটে রাখা প্লেট, চ্যাঙ্গারিতে জিলিপি রাখা, আর কাগজের ঠোঙ্গায় কচুরি ... এখনও একটু গরম আছে। প্লেটটা নিজে দিকে টানতেই দেখলেন, তলায় একটা ভাঁজ করা কাগজ - ফুলস্ক্যাপ পায়োনীয়ার খাতা, ধারটা একটু এবড়ো-খেবড়ো  হয়ে গেছে টেনে ছিঁড়তে গিয়ে ...

বাবা, 

গতকাল তুমি ক্লান্ত ছিলে, মা-ও... তাই চিঠিটা আজকে দিচ্ছি, নিশ্চয়ই কোচিং থেকে ফেরার আগে তোমার পড়া হয়ে যাবে, তা-ই এসেই বকুনি বা মার খাবো এটা জেনেই আজকে আর মন বসবে না পড়ায় ... 

দাদুভাইয়ের হাত কাঁপতো খুব জানো তো? তাই দুপুরে বাড়ি থাকলেই আমাদের ডেকে ডিক্টেশান দিতেন, ডায়রি লেখার জন্য, এক ঘন্টা টানা লিখে দিলে দশ দশটা টাকা! বলতেন আত্মজীবনী লিখছেন, তাই বানান-গ্রামার যেন একটুও ভুল না হয় ... তা-ও একটা দুটো হয়েই যেতো, কি করবো !

ডায়রিটা এখন সবসময় আমাদের স্কুল ব্যাগেই ঘোরে, আমরা টিফিন টাইমে আর ছুটির পরে ছোটবাড়ির ঠাকুরদালানে বসে পড়ি মাঝেমাঝেই, যেদিন খুব মনে পড়ে ... এখন প্রায় সবকটা পাতাই মুখস্ত হয়ে গেছে ... তাই তোমাকে না দেখেই বলতে পারি কবে কি হয়েছিলো !

ছোটোবেলায় খুব হাঁপানির টান ছিলো দাদুভাইয়ের, তাই টানা খেলতে পারতেন না ... তবে পায়ে নাকি দারুণ কাটাতে পারতো এদিক ওদিক, তাই রিজার্ভ বেঞ্চে বসতে হতো সব ম্যাচেই ... একটা বড় ম্যাচের ফাইনালে ডাক পেয়েছিলো, তবে খেলতে নয়, রেফারি আসেনি বলে দাদুভাই বাঁশি নিয়ে নেমে পড়েছিলো মাঠে, ভাবতে পারো? 

টিক্লুরও হাঁপানির টান, ওর-ও বেশী হাইটে যাওয়া কষ্ট, তবে ওর-ও খুব ইচ্ছে একদিন যাবে । দাদুভাইয়ের সকালের সেই গানটা আছে না, "পঙ্কে বদ্ধ করো করী, পঙ্গুরে লঙ্ঘাও গিরি"। আমাদের বলতেন পাহাড়ের মাথায় আজকাল নাকি সোজা হেলিকপ্টারেই যাওয়া যায়, একদিন নিশ্চয়ই সবাই মিলে গিয়ে দেখবো , তাই না বলো?

বইটা সত্যি ছিলো কিনা সেটা কিন্তু আমরা জানিনা, হয়তো ছিলো, সে গল্পটা আর ডিক্টেশানের সময় পাইনি... তবে ডায়রিটা র ভেতরে লেখা তোমাকে উৎসর্গ করে গেছে দাদু, আর মলাটের উপর নামটা কাঁপা কাঁপা হাতে লিখে গেছে নিজেই । 
আগে পড়তে পারিনি, কাল সন্ধ্যেয় গানটা শুনে চিনতে পারলামঃ 
"আমার শেষ পারানির কড়ি কন্ঠে নিলেম " ... 


ইতি,
টুবাই ও টিকলু