বেশ ছোটোই ছিলাম তখন, একটা গানের বইয়েই ওনার ছবি দেখি - শেষ বয়সের নজরুল ইসলাম, ততোদিনে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছেন - কথা বলার ক্ষমতাও... ছবিটায় কোনো একজন আত্মীয় বোধকরি নজরুলকে কিছু একটা খাইয়ে দিচ্ছেন চামচ চামচ, আর বৃদ্ধ কবি জবুথবু হয়ে বসে তাকিয়ে আছেন ক্যামেরার দিকে - অপার্থিব একটা দৃষ্টি, খুব জোর ভয় পেয়েছিলাম ... আর জানিনা কেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারিনি বইয়ের কথাগুলো, উনি তো কবি - আর তাও এতো বিশাল বড়ো বিখ্যাত কবি - তিনি নিরুত্তর হয়ে ছিলেন জীবনের শেষ তিরিশটা বছর? ছবিটা কি করে যেন অনেকদিন মনে ছিলো, মাঝে মাঝে ফিরে আসতো অদ্ভুত সময়ে - তারপর সেই বইটা কোথায় যেন হারিয়ে যায়, আর দেখিনি কখনো, সেই ছবিটাও ঝাপসা হয়ে হয়ে প্রায় মনেই পড়ে না এখন, শুধু অনেক অনেকদিন বোবা হয়ে থাকার পর যেদিন খুব ইচ্ছে করে দেওয়ালে, মাটিতে, জানলার শিকে মাথা ঠুকতে, খুব পড়ে পড়ে গোঙাতে ইচ্ছে করে যেদিন - সেই ছবিটার থেকে একজোড়া অপার্থিব চোখ আমাকে দেখে ... আমি জ্ঞান হারাই।
নাঃ, গান আমার গলা বা হাত কোনোটাতেই কোনোদিন আসেনি, নজরুলের লেখাও সিলেবাস আর শ্যামাসংগীত বাদ দিলে খুব একটা যে পড়েছি বা শুনেছি এমনটা নয় - অতএব এই গল্পটা এদের কাউকে নিয়েই নয়। আমার যখন বয়েস এই ছয় কি সাত, বাবা-মা খুব আশা করে আমাকে গান শেখাতে শুরু করে, আমাদের পাড়ার এক গানের দিদিমণি, গীতিকাপিসি - রোববার সকালে আসতেন, মাথার ঘাম পায়ে ও অন্যত্র ফেলে আমাকে সারেগামা অব্দি শিখিয়েছিলেন - আরেকটু হলে একটা গোটা রবীন্দ্রসঙ্গীতও নাকি শিখে ফেলতাম - শেষমেশ মাস খানেকের গৃহযুদ্ধের পরে বাপমা ও গানের পিসিমণি রণে ভঙ্গ দেন, আমার কপালে জোটে দুখানি তবলা ও মানিককাকু নামক এক সদাহাস্য উদ্ভ্রান্ত তবলা-পিতেমো ... এতদিন পর স্বীকার করতে বাধা নেই, তবলাজোড়াটাকে যে খুব ভালোবেসে বাজাতাম এমনটা একদমই সত্যি নয়, আমার সেই মুখচোরা ভীতু ছোটোবেলায় ওই নিরীহ নির্জীব দুটো জিনিষই ছিলো আমার স্ট্রেস রিলিভার। বাবা প্যাঁদাক, মা বকুক কি স্কুলের মৃত্যুঞ্জয় স্যার বেতের বাড়ি দিয়ে আমার বিপ্লবী পোঙা লাল করে দিক - নির্বিরোধে মার খেয়ে আমাকে সঙ্গ দিয়ে যেতো ওরা। দিব্যি চলছিলো আমাদের এই মিথোজীবিতা, তবু ক্লাস নাইন না টেনে উঠতে উঠতে লোকজন বুঝতে পারে, বছরের পর বছর ধরে আমার অসম্ভব নিষ্ঠা সত্ত্বেও যেভাবে ফুলঝুরির মতন প্রতিভা ফোটা উচিৎ ছিলো তার কিছুই হয়নি। একা একা তো দূরের কথা, ঘ্যানঘেনে অতুলপ্রসাদীর পাশেও আমার বাজনা যথোচিত পৌরুষ দেখাচ্ছে না।তারপর যা হয় আর কি, মানিককাকুর চাকরি সপ্তাহখানেকের মধ্যেই যায়, কোনো একটা বিকেলে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বরানগরের একটা পুরোনো পাড়ার একটা গলির মধ্যে একটা বেশ পুরোনো বাড়িতে ... উত্তর কলকাতার বনেদী বাড়ির কথা ঠিক যেমনভাবে গল্পে লেখা হয়, তেমনি - প্রায় ভেঙ্গে যাওয়া দরজা ঠেলে ঢুকলে একটা ছোট্টো শ্যাওলা পড়া উঠোন - পাশে একটা কলতলায় জমে থাকা এঁটো বাসনকোসন, মাছের কাঁটা, ছড়ানো ছেটানো ভাত আর তাই নিয়ে কয়েকটা কাক আর বেড়ালের জমিদখলের ঝগড়া। একটু কান পাতলে শোনা যাবে একতলার ভাড়াটেদের বাড়িতে একটু আগে শুরু হয়েছে বিকেলের সিরিয়াল আর পাশের সরু গলিটায় কোচিং ক্লাস কাটা একজোড়া সাইকেল আর দমকা দমকা হাওয়ার মতন চাপা গলার খিটিরপিটির ... তিনতলার দরজায় বেল একটা আছে বটে, কিন্তু তার ব্যাটারি সদ্গতি পেয়েছে বেশ কিছুকাল আগেই, মিনিট পাঁচেকের অধৈর্য্য কড়া নাড়ার পরে হাসিমুখে দরজা খুলে দাঁড়ালেন তিনি - বয়স সত্তর-পচাঁত্তর, একমাথা পাকা চুল আর মুখে কয়েকটা বসন্তের দাগ ... আমার বলরাম দাদু ... আমার আজকের গল্পের নায়ক ...
"তখন আমার বয়স প্রায় তিরিশ ছুঁই ছুঁই, একদিন ফ্যাক্টরী থেকে সাইকেল চালিয়ে ফিরছি - এদিকে কলকাতায় তখন নকশালদের তাণ্ডব, হাওয়ায় জোর খবর, বরানগরের কাছে সেদিন নাকি অ্যাকশন হবে মাঝরাতে, আমি তাড়াতাড়ি সাইকেল চালিয়ে ফিরছি, হঠাৎ দেখি সৎচাষীপাড়ার মোড়ে কারা যেন দাঁড়িয়ে, আমি তক্ষুনি সাইকেল উলটোদিকে ঘুরিয়ে প্রাণপণে চালিয়ে দিয়েছি ফ্যাক্টরীর দিকে - দশ পা যেতে না যেতে একটা রড এসে লাগলো পায়ের গোড়ালিতে, চেয়েছিলাম ফুটবলার হবো - হয়ে গেলাম তবলচি "
দাদু রোজ দুপুরে আফিঙ খেতেন, কাজের লোক কাজ টাজ করে দরজা খোলা রেখেই চলে যেতো, আমি ক্লাস শেষ করে নিউ তরুণের গলিতে ঢুকে সিগারেটে দুটান দিয়েই দৌড়ে দৌড়ে চলে আসতাম দাদুর কাছে তবলা শিখতে, চোখ বোজাই থাকতো, গলার আওয়াজ পেলে বলতেন - 'চ নিয়ে চ দেখি, বসি একটু বাইরের ঘরে' ... আমি স্কুলব্যাগ থেকে গল্পের বই বের করতাম, আর দাদু আপনমনে, যেন নিজেকেই শোনাচ্ছেন এই ভাবে শুরু করতেন গল্প - আমি যে সব শুনতাম আর শুনলেও যে রোজ নতুন কিছু পেতাম তা নয়, তবু এই চলতো বেশ খানিকক্ষণ - যতক্ষণ না আফিঙটা একটু নামে, তারপর দেওয়ালের ফাঁকফোঁকর ধরে ধরে রেওয়াজের ঘরে যেতেন তিনি - আমি খুব সাবধানে একজোড়া পুরোনো বায়াঁ-তবলা বের করে আনতাম চৌকির তলা থেকে। চোখ তখনো বোজা, পোষ্যের গায়ে যেভাবে সস্নেহে হাত বোলায় অন্ধ ভিখারী, ঠিক সেইরকম উপায়হীন আদরে দাদু খানিকক্ষণ ছুঁয়ে থাকতেন তবলাজোড়া - তারপর আস্তে আস্তে বোল ফুটতো ম্যাজিকের মত, আমি চুপ করে শুনতাম ঘন্টার পর ঘন্টা ; একতলার টিভি - পাশের বাড়ির ঝিয়ে-বৌয়ে ঝগড়া - গলির মুখে কোচিং কাটা প্রেম সবকিছু আস্তে আস্তে কোথাও যেন হারিয়ে যেতো, সেই তেহাই, রেলা, টুকরার মাঝে আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নামতো সেই শহরতলীর গলিতে ...
রোজ দুপুরে নেশা করতেন বললাম নাকি? না না রোজ করতেন না, মাসের পয়লায় বড় মেয়ে আসত টাকী থেকে, সেদিন আমাদের মাইনে দেওয়ার আর রশিদ নেওয়ার দিন - সই করতে পারতেন না দাদু, টাকা গোনার ক্ষমতাও ততোদিনে নেই, ফ্যালফ্যাল করে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে থাকতেন তিনি - সেদিন গল্প আসত না, তবলা বের করে সামনে রাখলে ভয়ে ভয়ে বাজাতেন দু তিন ফেরতা, তারপর হঠাৎ করে চুপ করে গিয়ে বলতেন, 'বাপ-জ্যাঠায় গোঁড়া বামুন ছিলো, খোজার কাছে শিখতে দিলে না - না হলে আজ টাকাটা নিতে হতো না রে দাদুভাই' । আমি মাথা নিচু করে মন দিতাম বায়াঁ তবলাটার দিকে, উঠে যাওয়া গাবটাকে বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে বাজিয়ে যেতাম সদ্য শেখা ঝাঁপতালের কায়দাটা ... তার কিছু দিন পরে রেওয়াজ ঘরের দেওয়ালে একটা দৈনিক বসুমতীর কাটিঙ খুঁজে পেয়েছিলাম, হ্যাঁ আমার দাদুর নামের আগে একটা পন্ডিত উপাধিও ছিলো আর সেই রংচটা ছবিটায় দাদুর পাশে ছিলেন আর কেউ নয়, স্বয়ং বিসমিল্লাহ খাঁ ...
আমার মাধ্যমিক চলে আসে, খবরের কাগজে নাম তোলার তাগিদে ছেড়ে দিই সবকিছুই, বরানগরের সেই গলিতেও আর যাইনা প্রায় একযুগ - তারপর হস্টেল, কলেজের পড়া ... তবলা আর আমার ছাড়াছাড়িটাও হয়ে যায় আমার অজান্তেই। বছর দুয়েক পরে সে পাড়ায় গিয়ে জানতে পারি দাদু বাড়ি ছেড়ে দিয়েছেন অনেককাল , এখন ছোটো মেয়ে আর জামাইয়ের সাথে থাকেন অন্য পাড়ায়। আস্তে আস্তে অনেক বড় হতে থাকি আমি, আর পন্ডিত বলরাম মুখুজ্জে সেই রংচটা পেপার কাটিঙের মতোন হারিয়ে যান কোথাও একটা -
দু হাজার ছয় কি সাত সাল হবে সেটা, একদিন বিকেলে পাড়ায় ঘুরছি একা একা, হঠাৎ পাশের পাড়ার চায়ের দোকানে দেখি শালমুড়ি দিয়ে জবুথবু হয়ে বসে আছেন তিনি - চিনতে পারলেন সঙ্গে সঙ্গেই, চা খাওয়ালেন, গল্প করলেন অনেকক্ষণ - তারপর বললেন, ' আজকাল বড়ো হাত কাপেঁ জানিস দাদুভাই, বাজাতে পারি না - কিন্তু মনে মনে এখনো রোজ রেওয়াজ করি, তারানার সময়ে একটু জিভ জড়িয়ে যায়, না হলে এখনো ঘণ্টার পর ঘণ্টা ... '
দাদুর কোনো কথাই কোনোদিন শুনিনি আমি, তবলাটাও বশ মানেনি কোনোদিনই - তবু, এখন যখন অনেক অনেক দিন একটাও লেখা বেরোয় না হাত দিয়ে, প্রত্যেকটা শব্দ প্রত্যেকটা লাইন আমার দিকে আঙ্গুল তুলে হাসে - সেই বোবা দিন রাত্রি গুলোতে আমিও একটা শাল মুড়ি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যাই অনেক দূরের অন্য পাড়ার একটা চায়ের দোকানে, সেই চেনামুখ গুলো দেখতে পাই আশেপাশে - আমার হাত কাঁপে, লিখতে পারিনা একটা শব্দও, তবু মনে মনে ভেবে ফেলি হাজার হাজার গল্প - শুধু তারানার সময়ে একটু জিভটা জড়িয়ে যায়, এই যা।