Sunday, July 16, 2017

ট্রেনের গল্প



লীলা মজুমদার লিখেছিলেন, গল্প হয় ভূতের, নয় চোরের, নয় বাঘের নয় ট্রেনের ... তা আমার এ ইহজীবনে খাঁচার বাইরে বাঘ দেখার সৌভাগ্য হয়নি, আর শোনা সব বাঘের গল্পেই গরু আছে, কাজেই সেসব এখন মুলতুবি ...  তবে চোর আর ভূত দেখেছি গণ্ডা গন্ডা, আমাদের ওদিকে তো নাইটগার্ড বলে কিছু হয় না, সিঁধকাটা আর স্কন্ধকাটারাই দেখেশুনে রাখে। ওরাই ছাতে মাদুর পেতে ঘুমোয়, রাত্রে পাড়া টহল দেয়, ব্যানার্জীদের রকে বসে আড্ডা মারে, তিনপাত্তি খেলে - তবে হুট করে কাছে গেলেই তারা মিলিয়ে যায়, দু-একটা পোড়া বিড়ির টুকরো আর খালি ঠোঙা উড়ে বেড়ায় মৃদু বাতাসে ...

তা এই রকের আড্ডায় যা দারুণ সমস্ত গল্প শুনেছি, বলবো একদিন, একটু রাত্তির করে বেশ জমিয়ে বসে, একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ... তবে উত্তর কলকাতার ভুত তো, ভয়-টয়ের কারবারে নেই, বরং বেশীর ভাগই বেশ লাজুক এবং নিতান্ত ছাপোষা ... এই যেমন এক জেঠুমানুষ ছিলেন পাড়ায়, সাত্ত্বিক প্রকৃতির, মাঝে মাঝেই এসে গাঁটের ব্যাথার জন্য একদাগ আর্ণিকা আর আমাশার জন্যে অ্যালোজ নিয়ে যেতেন। বাবার কাছে শুনেছি জেঠ্যু সাধনোচিত ধামে পাকাপাকি চলে যাবার পরেও মাঝে মাঝে সকালে উদয় হতেন চেম্বারে, বাজারের লঙ্কা থেকে লাউ কেমন আগুন দাম বলে গজগজ করে দুই পুরিয়া ওষুধ নিয়ে চলে যেতেন ... অব্যেস তো, ডাই হার্ড ...

এই অব্দি পড়ে যদি ভেবেছেন যে ভর-সন্ধ্যায় ভুতের গল্প ফেঁদে বসেছি, ভুল করছেন ... এটা আসলে ট্রেনের গল্প । আমার বাবা নেশায় ছিলেন হোমিওপ্যাথ, পেশায় রেল-কর্মচারী - বছরে দু-দুটো পাশ পেতেন আর আমরা পুজোর ছুটি, শীতের ছুটি দেদার ঘুরে বেড়াতাম এদিক-ওদিক। প্রায়ই প্ল্যান শুরু হতো পুষ্কর লেক দিয়ে, শেষ হতো পাশের পাড়ায় পুরীর বীচে ... কখনো আবার হঠাৎ করে দেখতাম একগাদা কিচিরমিচির করা ফ্যামিলি নিয়ে চলেছি পাহাড়ে বা সমুদ্রে। ইস্কুল থেকে কলেজে উঠে তো আরো মজা, ফি বচ্ছর শিক্ষামূলক ভ্রমণ হয়, একজন অসহায় টিচার, আর একগাদা উচ্ছৃঙ্খল জনতা। আমাদের সেই ছোটো আর মাঝারি-বেলার সব গরমের ছুটি যদি একটা আঁতেল আর্ট ফিলিম হয়, তার ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হবে শুধুই কু-ঝিক-ঝিক এবং ফাঁকে ফাঁকে 'চায়ে গ্রম চায়ে' ...

হাওড়া থেকে ট্রেন ছাড়তো বেশ রাত্তিরে, আর বাড়ি থেকে স্টেশন যাওয়াই এক ঝকমারি কান্ড, ধরুন যাবেন বেনারস, মেরে কেটে ষোলো-সতেরো ঘন্টা - তার জন্য খাবার প্যাক হবে চার দফা, লুচি-আলুর দমের সঙ্গে মিষ্টি, মাঝে মাঝে উসখুস করলে চানাচুর, দু-একটা ফল-টল তো এম্নি-ই চলে আসে। ঘুম থেকে যখন উঠতাম সকালে, আপার বার্থ থেকেই দেখতাম বাইরের মাঠের রঙ পালটে গেছে, সবুজ ফিকে হচ্ছে, আস্তে আস্তে ধূসর, মাঝে মাঝে সেই ভুষুন্ডির মাঠের ঠিক মধ্যিখানে একটা করে টেলিফোনের বা ইলেক্ট্রিসিটির টাওয়ার, বলা-নেই-কওয়া-নেই দু-একটা টানেল আসে হঠাৎ হঠাৎ করে... আর শহরতলি পেরোতে পেরোতে লেভেল ক্রসিং, ব্যস্ত মানুষ-গরুতে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর আপনি তাদের টা-টা করতে করতে চললেন হলিডে হোমে ...

বাবার কল্যাণে ফার্স্ট ক্লাসে উঠতে পেতাম, দরজা দেওয়া আলাদা কেবিন, বাথরুম থেকে  দিরে এসে দেখবেন না উটকো লোকে উঠে জায়গা নিয়ে গেঁড়ে বসে আছে, তবে জার্নিও নেহাৎই অ্যাডভেঞ্চার-হীন, সে এসি টু-টায়ারে স্বামী ঘুটঘুটানন্দও উঠবেন না যোগসর্পের হাঁড়ি নিয়ে, সামনের বেঞ্চি থেকে জটায়ুও হঠাৎ বলে উঠবেন না , 'এখানে রোদের তেজ-ই আলাদা, সাধে কি আর লোকগুলো এতো পাওয়ারফুল?' ... দূরপাল্লার ট্রেনে রেলের ক্যান্টিন থেকে খাবার আনানো হতো, সেসব অখাইদ্য খাবার কিন্তু ওই থালা গুলোর ওপর হেব্বি লোভ ছিলো, সুন্দর খাপ কাটা-কাটা ...

দামড়া বয়সে বন্ধুদের সাথে যাওয়ার সময় তো গোটা ট্রেন জার্নি-ই পেটের উপর কুজ্ঝটিকা ! একবার ঠিক হলো, হাওড়া-টু-দিল্লী প্রত্যেকটা স্টেশনে পুরি-তরকারি খেয়ে বেস্ট পুরি ঠিক হবে ভোটাভুটি করে, আরেকবার ঠিক হলো কোথাকার ঝালমুড়িতে কত ঝাল না জানলে জীবনটাই বৃথা ... (এক দাদা আবার ঝালমুড়িতে ঝাল না পেয়ে আরেক আলুকাবলিওলা-র কাছে একটা কাঁচা লঙ্কা ধার চেয়েছিলো, বলেছিল ফেরার ট্রেনেও তো উনি-ই আবার উঠবেন, তখন না হয় একটা কাঁচা লঙ্কা ফেরত দিয়ে দেবে।)

সব গল্পেই একটা না একটা ভিলেন থাকলে জমে না, আমাদের ট্রেনের গল্পের ভয়ের মুখোস পরে থেকে থেকে হানা দিতো টিটিই-রা, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবার হাতে টিকিট দেখে তবে ছাড়, একটু এদিক-ওদিক হলেই ... বাঘে ছুঁলে যদি আঠারো, পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ... টিটিই ছুঁলে কত হয় তা যাঁরা টের পেয়েছেন সে হতভাগারাই জানেন ... এই যেমন আমি ...

আমাদের কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, গোয়া যাওয়া হবে, এক্কেবারে শিক্ষামূলক ট্যুর ... যাওয়ার আগের দিন ভোররাত্রে জানা গেলো কোনো এক মহাপুরুষ গোটা কলেজের গ্রূপ টিকিট ঝেঁপে দিয়ে আম্বানি হয়ে গেছে ... এদিক আমাদের সমবেত পুচ্ছে হালকা করে হাম্পু ! কিন্তু সে নতুন জওয়ানির জোশ, একবার ছাড়া পেলে ধরা মুশকিল, ঠিক হলো ট্রেনে উঠে পড়া হবে, তারপর ম্যানেজ দেওয়া যাবে। সে যা জম্পেশ ট্রেন জার্নি হয়েছিলো, র‍্যামসে ব্রাদারকেও হার মানায়, দমবন্ধ সাস্পেন্সের মাঝে নতুন নতুন রিউমার, কেউ বলছে দুটো স্টেশন পরে রেল্পুলিশ দাঁড়িয়ে  হাতকড়া গুনছে, কিন্তু এতো বিশাল গ্যাং বলে হয়তো কোমরে দড়ি-ই নিয়তি, আশাবাদীরা খবর আনছে কোন সিনিয়রের বাবা নাকি কোন মিনিস্টারের খাস বন্ধুর পাশের ফ্ল্যাটেই পার্টি করে , গায়ে হাত দিলেই একটা ফোন, গোটা রেল কোম্পানি উঠে যাবে ... (শেষমেশ কি করে পৌঁছেছিলাম, ঠিক জানিনা, আজ-ও) ...

তবে এক মাঘে শীত যায় না, বিশেষ করে বাঙ্গালীর তো নয়-ই ... দিল্লী থেকে ট্রেনিং শেষে ফেরার দিন, বন্ধুরা জোরকদমে প্যাক করছে, আমি জানি আমার টিকিট পরের দিন, আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের টিকি(ট)-ও আমার জিম্মায়, আজ রাত্রে বরং সাঁটিয়ে রাজিন্দর ধাবায় তন্দুরি খাওয়া যাক ... পরের দিন পূর্বা এক্সপ্রেস ধরতে যখন স্টেশানে পৌঁছলাম, পানু জিগ্যেস করলো, "টাইমটা ঠিক দেখেছিস তো? সাড়ে চারটে?" ... আমি পকেট থেকে টিকিট বের করে দেখি হ্যাঁ টাইম-এ ভুল হয়নি, ট্রেনটা একদিন আগেই ছেড়ে চলে গেছে । ভাগ্যি দুজনের পকেটে মিলিয়ে অল্প টাকা ছিলো, টিটি এসে জেনারেল ক্লাসে তুলে দিলো ... বাথ্রুমের পাশে, লোকে হিসি করছে আর মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে বিড়ি ফুঁকছে, আর দরজার বাইরে পা ঝুলিয়ে বাড়ি ফিরছি আমরা ...

ব্যাপারটা রোম্যান্টিক ভাবছেন? আদৌ না ... এই ধরুন যাচ্ছেন মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে, আগের কামরার ফ্যামিলির ডিনার শেষ হলো ... হঠাৎ বসে বসে দেখবেন একের পর এক মিসাইলের মতো এটোঁ পাতা আর প্লাস্টিক জানলা থেকে ধেয়ে আসছে আপনার দিকে, অনেক ডজ করে যাও বা সে পুষ্পবৃষ্টি এড়ালেন, শুরু হলো কুল্কুচি করা জলের বন্যা ... পানু ছেলেবেলায় যোগাসন আর জিম্ন্যাস্টিক, দুয়েই চ্যাম্পিয়ন ছিলো - হঠাৎ এক অপোগন্ড কুচো আর তার বাপ-মা সভয়ে দেখলো, রাতের অন্ধকারে পূর্বার জানলার শিকের বাইরে দিয়ে একটা ভয়াবহ রোদে পোড়া , দাড়িয়াল মুন্ডু, সে বাংলা-মেশানো হিন্দিতে শাসাচ্ছে ; ফির সে জানলা দিয়ে কচড়া ফেঁকলে তার গুষ্টি কি তুষ্টি ... আমার বিশ্বাস স্বচ্ছ ভারত অভিযানের প্রথম সেনানী সে-ই ... আমার বন্ধু পানু ...

আর ভয় ছিলো রেল-গার্ডদের, বিশেষ করে যদি বিড়ির নেশা থাকে, দরজার কাছে গিয়ে এক বন্ধু খাবে আর আরেকজন গার্ড দেবে দেখার জন্য কেউ আসছে কিনা ... কেউ কেউ আরেকটু কড়া বিপ্লবী, কাউকে কিছু না বলে ঢুকে পড়তো বাথ্রুমে ... এইরকম-ই একজন ছিলো মাতাল, মনের আনন্দে সিগারেটে শেষ টান টা দিয়ে যেই বেরোবে, দ্যাখে বাইরে রেলের গার্ড হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। মাতলু-ও চুঁচড়োর খুনখার আদমি, হাত তুলে বললো, "কই সিগারেট কিধার? সার্চ কিজিয়ে ! " রেল গার্ড দেখলো বিপ্লবীর উত্তোলিত হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরা এক-প্যাকেট দেশলাই !

স্লিপার-ক্লাসে হরদম উঠতো নানারকমের খাবার-দাবার, আর উঠতো অনেক অনেক টিকিট-ছাড়া যাত্রী, এক কোণে টুক করে বসে পড়ে তাঁরা সমাধি লাভ করতেন - তারপর যাই জিগ্যেস করুন, "কোথায় যাবেন? সিট কোথায়? মামার বাড়ী পায়া হ্যায় ক্যায়া?" - সবের-ই উত্তর সেই এক, নির্বিকার নৈঃশব্দ ! সে এক তুমুল ক্যেওস ... হঠাৎ সবাই দেখলো ট্রেনের সব কামরায় হইচই, খালি মাঝে একটি আশ্চর্য মরূদ্যান ! জানা গেলো সেই কামরায় যাতায়াত করছেন আমাদের আরেক দাদা, যার অনেক অতিমানবিক ক্ষমতার মধ্যে একটি হচ্ছে যোজনগন্ধী পায়ের মোজা ... যেখানে তিনি শ্রীচরণকমল দুখানি ন্যস্ত করতেন, কয়েক মাইলের মধ্যে মশা-মাছিরাও টুপটাপ মরে ঝরে পড়তো আকাশ থেকে ... তারপর থেকে কতবার যে তিনি বিপদভঞ্জন হয়ে এসে দাঁড়িয়েছেন দুর্ভ্যেদ্য জঙ্গল থেকে দুরন্ত এক্সপ্রেস, শুনলে লোকনাথ বাবাও নতুন চাকরি খুঁজবেন ...

লিখতে লিখতেই অনেক ভাবলাম, নাঃ আমার শেষ দূরপাল্লার ট্রেনজার্নি সেই দিল্লী টু হাওড়া, বাথ্রুমের পাশে মেঝেতেই ... এদিক-ওদিক খুচরোগুলো বাদ দিলে ... আর মনে পড়লো, আমার সেই বন্ধুর এক ছাত্রের কথা ... তার বাবা-মাও আমাদের লাইনের, অঙ্ক কষে জীবন কাটিয়েছেন, ছেলেকেও সেইদিকেই ঠেলাঠেলি করতেন ... আমাদের ট্রেন-কাহিনী যখন লোকের মুখে মুখে ফিরছে, ছেলেটি সাহস পেয়ে বাবা-মা কে গিয়ে বললো, 'দেখেছো তো সারাজীবন গাঁতিয়ে অঙ্ক করলে কি দশা হয়? আমি বরং ফিজিক্সটাই মন দিয়ে পড়ি' ...


Saturday, March 11, 2017

রঙ-রুটের বাস



শিকড়-বাকড় প্রায় সব-ই ছিঁড়ে গেছে অনেকদিন হলো, তাও পলিটিক্স আর পপুলেশন বৃদ্ধির বাইরেও এককালে একটু-আধটু খবর রাখতাম, আর কিছু না হোক কবে কি পালা-পার্বণ হচ্ছে ্সেটা ঠিক জেনেই যেতাম - হঠাৎ আজ সকালে ফেসবুক  খুলে জানতে পারলাম দেশজুড়ে দোল হচ্ছে .. শুনেই এই প্যাচপেচে বৃষ্টির দিনে মনটা আরেকটু স্যাঁতসেঁতে হয়ে গেলো ...

এ পোড়া দ্যাশে ভাঙ-টাঙ পাওয়ার তো কোনো আশাই নেই, উদ্যমী দেশোয়ালি ভাই-বেরাদরদের দেখা পাওয়াও মির‍্যাকলের সমতূল্য, কাজে এক্কাপ কফি খেয়েই চোখ বুজে কল্পনা করে ফেললাম খানিক। পষ্ট দেখলাম চারদিকে রংজলে ভরা বেলুন ছুটছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের মতন, কিছু হনুমান রঙ মাখা ছেলেপিলে জামা কাপড় ফর্দাফাঁই করে হিংস্র উল্লাসে লাফাচ্ছে - আমার আবার ভায়োলেন্স পোষায় না, তাই মাঠের এককোণে একটা থান ইঁটে মাথা দিয়ে দিব্য নাক ডাকাচ্ছি ... আর পাশে কোনো এক সদ্য প্রেম সেরে ওঠা কিশোর, ভারি দুঃখের সাথে ধানাইপানাই করছে, সিদ্ধিলাভ মনে হচ্ছে আর বেশী দূরে নেই ...

অবিশ্যি ছোটোবেলায় দোল ব্যাপারটা আদৌ হোলি ছিলো না আমাদের বাড়িতে, বাবা-মা কচি বয়সেই ঘোষণা করে দিলেন, দোল মানে বড়োজোর গুরুজনদের পায়ে অল্প একটু এবং বিনিময়ে মাথায় আরো কম আবির - এবং বেসরকারী কারফিউ, রাস্তায় ওৎ পেতে কারা যেনো বসে আছে, বেরোলেই নর্দমার জলে চুবিয়ে বাড়ি পাঠাবে ... পরেরদিন স্কুলে গেলে দেখতাম এক ক্লাস পরিষ্কার করুণ মুখের মাঝে কয়েক জোড়া লাল-রঙা কান আর বিজয়ীর হাসি, টিচারের বকুনি খেয়ে চওড়া থেকে চওড়াতর হচ্ছে সেগুলো - সেই নিষ্পাপ নব্বুইয়ের সেইগুলোই ছিলো আসল প্রতিবিপ্লব ...

আমারও সহজেই সময় এসে গেলো, পাড়ায় মাঠের বন্ধুরা বললো - পরের দোলে আমায় বাঁদুরে রঙ মাখানোর দায়িত্ব গোটা জামরুলতলার। বাবা প্রথমে নর্দমার জলের ভয় দেখালেন, তারপর বুঝলেন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী আইসক্রিম, পেপসি সবতেই নর্দমার ভয় টেনে এনে ব্যাপারটাকে ধর্মঘটের মতোই অকেজো করে ফেলেছে, তারপর বললেন বেলুন মারলে লাগবে, তাতে বললাম তাহলে শুদ্ধু বড়োদের দিকেই ছুঁড়বো - শেষমেশ বললেন জোর করে সিদ্ধি-ভাঙ খাইয়ে দিতে পারে, বলেই বুঝলেন জোরটোর লাগবে না, সেসব দৈব প্রসাদের প্রতি জন্ম থেকেই আমার অবিচল ভক্তি ...

তারপর থেকেই দোলের মানে হুট করে পালটে গেলো - সেই সকালে মা একটা পুরোনো টিশার্ট বের করে দিতেন গজরগজর করতে করতে, আমরা কয়েকজন এপাড়া ওপাড়া ঘুরে দস্তুরমতন গোটা এলাকায় দোলের ধাত এবং জাত নিয়ে রিসার্চ করে বাড়ি ফিরতাম বেলা গড়িয়ে - বাবা তখন খ্যাপা টাইসনের মতন রিঙে পায়চারি করছেন, বাড়ি ঢুকলেই হুক-পুল-জ্যাব মেরে সোজা কলতলায় - আমার কুছ পরোয়া নেই, পরের দিন স্কুলে গিয়ে আমিও গল্প বলবো -- সাঁতরাপাড়ায় কেমন পাবলিকের চান করার জায়গাটায় রঙীন চৌবাচ্চা বানিয়েছিলো, মাম্পির বাবা কেমন বাড়ির বাগানে লুকিয়ে রেখেছিলেম পাড়ার নেড়ী-ন্যাড়াদের, রঙের থেকে বাঁচাতে - আর শেষে বলবো সেরাটা,  পেয়ারাবাগানের গলিতে আমার আর আমার বন্ধুর মাথায় ছাদ থেকে বালতিভর্তি জল ঢেলে দিলো একটি মেয়ে, "পালিয়ে যাওয়ার আগে একবার চোখাচুখি" - দোলের গল্পেও রঙ না চড়ালে আর কিসে চড়াবো, বলুন?

তবে নাঃ, সিদ্ধি-টিদ্ধি কেউ দিতো না, সেই কলেজে যাওয়া অব্দি দোল এক্কেবারে মাটিতেই কেটেছে ... কলেজে তো এলাহি ভরোসা, মেসের টেবিলে বিশাল বিশাল গামলায় মেসের কালিদা-বংশীদারাই বানিয়ে রাখতো অমৃতের শরবত, আ-হা ! তার বর্ণনা দেওয়ার ক্ষমতা এই খাগের কলমে অন্ততঃ নেই - তবে হ্যাঁ, যা যা ম্যাজিক দেখতাম ভোলবার নয় ...

এক দোর্দন্ডপ্রতাপ জুনিয়র ছিলো, জেজে, চট করে তার পা বা মাথা টলে না, হরলিক্স পার্টিতে হাফ-ছাদ যখন মৃদুমন্দ মলয় বাতাসে উড়ে বেড়ায় ইধার-উধার, জেজে তখন মন দিয়ে এটাসেটামিক্স করে বা নিপুণ দক্ষতায় পথভোলা পথিকদের পৌঁছে দেয় নিজ নিকেতনে ... একবার দোলের দুপুরবেলা, সেই জেজে, আমি, আরো কয়েক ঘোর পাপী বসে আছি মেসের মাঝখানে গোল করে, আর এক বন্ধু যাকে রাঙানোও যায়নি, ভাঙানোও যায়নি ... হঠাৎ সবাই বুঝলো কেউ-ই প্রায় ঘন্টাখানেক কোনো কথা বলছে না, খালি ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে বেড়ালের মতন হেসেই চলেছে - থামার নাম নেই , আর সেই একজনের বদ্ধমূল ধারণা সবাই তার উপরেই হাসছে, কিন্তু কেন কেউ জানেনা... একটু পর জেজে প্রথম কথা বললো, 'বুঝলে, সিদ্ধি হচ্ছে অনেকটা ইথার তরঙ্গের মতন, যারা খেয়েছে সবাই কানেক্টে্‌ড, বাকিরা সিগন্যাল ধরার লোভে অ্যান্টেনা বাড়িয়ে আছে, কিন্তু ক্লিয়ার পিকচার আসছে না' ...

সেদিন বাড়ি ফেরার সময় ফাঁকা মিনিবাসে উঠে জেজে দুটো টিকিট চেয়েছিলো, কন্ডাক্টর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকায় একটু পরে বলেছিলো, কেনো একটা আমার, একটা আমার ব্যাগের !

আমি দুপুরে বাড়ি ফেরার রিস্ক-ই নিইনি, সন্ধ্যেবেলায় হঠাৎ একটা ফোন আসে, এক পোটেনশিয়াল ছাত্রীর, অঙ্ক শিখতে চায়, তাদের বাড়ি গেছি, সন্দেশ-শরবৎ সাজিয়ে দিয়েছে, আমার এদিকে প্লেটে হাত দিয়েই মনে হলো অনেকদিন ক্যারম খেলা হয়নি, একটা গোলপানা কড়াপাকের মিষ্টিকে স্ট্রাইকার বানিয়ে একটা ইঞ্চি শট অনেকক্ষ্ণ ধরে মেপে যাচ্ছি - হঠাৎ পর্দার ওপার থেকে দয়ালু কাকিমার গলা ভেসে এলো, 'বেশী অঙ্ক-টঙ্ক করলে না এরকম হয়ে যায়, আমার মেয়েটাকে বরং ডাক্তারিটাই পড়িয়ো বুঝলে?' ...

আরেকবার দোলের সন্ধ্যেয় পূর্ণিমার চাঁদটাকে তাড়া করে করে ঘুরে বেড়িয়েছিলাম আমি আর এক বন্ধু মিলে, ঠিক করেছিলাম সেই রাত্তিরে গোটা উত্তর কলকাতার সবকটা চায়ের দোকান ঘুরে চা খেয়ে ঠিক করবো কার চা সবচাইতে ভালো - কোথায় কোথায় ঘুরেছিলাম সেটা আর মনে নেই, তবে সেরা চায়ের দোকানটা মনে আছে আবছা - একটা উঁচু রেললাইনের জমি, তার তলার একটা গুমটি ঘরে একটা দিদু চা বানায় কেরোসিনের স্টোভে ...

লিখতে-লিখতেই মনে পড়লো সেদিন সন্ধ্যেবেলাও ঠিক এমনি টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছিলো সারাক্ষণ, ভিজতে ভিজতে একটু হাঁটা, আবার ছাঁট দেখলে দাঁড়িয়ে একটা সিগারেট ... বুড়ি দিদুর দোকানে কেউ আসেনি সেদিন ... অনেকক্ষ্ণ গল্প করেছিলাম ... বাড়ি ফিরে সেদিন আয়নায় দেখেছিলাম বৃষ্টিতে ভিজে রঙ আর নেশা দুটোই ফিকে হয়ে গেছে একদম ...

তারপর আর খেলিনি, নাঃ ... খুব বৈরাগ্য টাইপের এসে গেলো ... কোলাহল আর ভালো লাগতো না, ফাঁক পেলেই ছুটে শান্তিনিকেতন চলে যেতাম, বসন্তোৎসব মনে হতো স্বপ্নের মতো, সকালবেলায় "ওরে গৃহবাসী"-র সাথে গলা মেলাতে মেলাতে অবাক হয়ে দেখছি ফাগুন হাওয়ায় উড়ন্ত গুলাল, মনে মনে কোথাও ওই হলুদ-লালের দলে মিশে যেতে চাইছি আমিও, দলে ভিড়ে দুপুরবেলা যাচ্ছি কঙ্কালিতলার মাঠ, বিকেলের দিকে কি কোপাই ? ... হয়তো সে আর এক জন্মের কথা, ওই কোপাইয়ের মাঠেই হয়তো বসে আছি ... গলা বেয়ে গান উঠছে আজ, বন্ধুরা সারি সারি সাইকেল গাছের গায়ে ঠেস দিয়ে রেখেছে আর মাদল বাজছে জ্যোৎস্নার চরাচরে, সবাই নাচছে আগুনকে ঘিরে ...

কখনো ভাবতাম নাঃ, অনেক দূরে কোথাও অন্য কোনো দেশে যেন জন্মেছি আমি, বৃদ্ধ হয়েছি লেখার পিছনে ছুটে ছুটে... জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বরফে ঢাকা ঝাউগাছের তলায় বাচ্চারা দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আমি ধূমায়িত কফির কাপের পাশে টাইপরাইটারের সামনে পরের প্লটটা ভাবছি ...

যেন সেই স্বপ্নের মধ্যেই জেগে উঠলাম আজ, বাইরে এখনো সেই অঝোর বৃষ্টি, সেই ধূসর আকাশ, তার মাঝে খানিক শিল পড়লো যেনো টুপ্টাপ করে, গিন্নীমশাই কফির কাপে শিল ধরতে গিয়ে ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপ্টা খেয়ে পালিয়ে এলেন, এখন আমার চারপেয়ে ছানা মেচকু সারা পাড়াকে কীর্তনগান শুনিয়ে তেনার কোলে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে আর স্বপ্নে খরগোশ আর কাঠবেড়ালী তাড়া করে যাচ্ছে প্রাণপণ .. লেখা শেষ করেই ওদের শোনাবো, তারপর দারুণ এককাপ চা আর সিঙ্গারা ! কে বলেছে আরকানসায় দোল আসে না?