Saturday, April 4, 2020

মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়

অনেকদিন চুপচাপ ছিলাম, বিভিন্ন কারণে। এক, আমার ছোটো পিসি চলে গেলেন কিছুদিন আগে, আকস্মিক সেরিব্রাল অ্যাটাক । কয়েকদিন আগেও কথা বলেছেন আত্মীয়-স্বজনদের সাথে, খবরাখবর নিয়েছেন ... বলেছেন, 'অনেকদিন দেখিনা, একদিন আসো'! পিসেমশায় আমতার ইস্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন, হেডমাস্টার মানুষ যেমন হয় তেমনি, পুরু ফ্রেমের চশমা পরা, চোখের সামনে হয় আনন্দবাজার না হলে পরীক্ষার খাতা ... আর পিসিমণি ছিলো নরম-সরম, আদরের মানুষ, ছোটোবেলায় আমি তাঁর ডাকনাম রেখেছিলাম গদীপিসি।
বাবার কাছে গল্প শুনেছি, বন্যায় সব ভেসে গেছে, আর বাবা, আমার মামাকে নিয়ে সঙ্গে মাথায় পোঁটলা বেঁধে প্রাণ হাতে করে পৌঁছেছেন ছোড়দির বাড়ি ... শুনেছি পিসেমশাইয়ের শখ হয়েছিলো ভোটে দাঁড়াবেন নির্দল প্রার্থী হয়ে, পিসিমণি নিজের গয়না বাঁধা রেখে টাকা তুলেছেন জামানত-এর ... সেই মানুষ-টা বোধ হয় হঠাৎ একটা পছন্দের স্টেশন দেখে জীবনের ট্রেন থেকে নেমেই পড়লেন সবাইকে ফেলে ! আর এমন-ই দুর্যোগের দিনকালে, যে আমার অশীতিপর পিসেমশাই শেষকৃত্য সেরে বাড়ি ফিরলেন যে লকডাউনের দিনগুলিতে, সেদিন তাঁর পাশে এসে বসার অনুমতি নেই কারুর ... হ্যাঁ, ভালোর জন্য-ই, জানি, কিন্তু সেই ছায়াঘেরা ছোটবেলার স্মৃতির বাড়িতে এখন 'আছে শুধু নেই' অগুন্তি মৃত্যুর মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে নিজের শোক বড়ো অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। তা হোক, ছোটোবেলায় যে তারস্বরে চেঁচিয়েছি সকাল সাতটার প্রেয়ারে ... 'মৃত্যোর্মা অমৃতংগময়', তার কী কিছুই ফল পাবো না?
আর দুই, ব্যস্ততা ... জীবনের গভীর শোকের দিনগুলিতে কোনো কবিতা নয়, উক্তি নয় ... কাজ, কাজ, কাজ, পাগলের মত কাজ-ই আমাকে বারবার টেনে তুলেছে ... গত দুই সপ্তাহ, এই আরকান্সা রাজ্যের একদল লোক, কেউ পাবলিক হেলথ এক্সপার্ট, কেউ এপিডেমিওলজিস্ট, একজন স্প্যাশিয়াল টেকনোলজি-র মহীরূহ, এঁরা সবাই মিলে দিন-রাত এক করে একটা দরকারী কাজ করছেন ! সবাই মিলে এনারা বোঝার চেষ্টা করছেন এই অঞ্চলের হাসপাতালের উপরে কতোটা চাপ পড়বে, কি করলে সেটা সামলানো যেতে পারে, ইত্যাদি ... সেখানে আমি যতটুকু পারি সাহায্য করছি, যা দু-পাতা পুস্তকস্থা তু যা বিদ্যা রয়ে গেছে তাই দিয়ে ! ( কতো লোকে যে এগিয়ে এসেছেন, কাঁধে-কাঁধ লাগিয়ে লড়ছেন, সেটা ভাবলে এই মৃত্যু উপত্যকার দাঁড়িয়েও ইচ্ছে করে একটা বড়ো শ্বাস নিতে ... খুব ভয় করে বাড়ির লোকেদের জন্য, পাগলের মতো ভয়, ভবিষ্যত ভয়ানক অনিশ্চিত মনে হয়। এই বিশাল মৃত্যুর মিছিলের বোঝা চেপে ধরে দশদিক থেকে... আর ধুলোর মধ্যে, খিদের মধ্যে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে হেঁটে যেতে যেতে সেই মিছিলের শিশুরা জিগ্যেস করে, লগ-স্কেলে আঁকবো, না লিনিয়ার? ... কিন্তু এই যে মোমবাতিটুকু কাঁপছে ঝোড়ো হাওয়ায়, এইটুকু দুই হাত দিয়ে আগলে রাখা দরকার ... যদ্দিন হাত দুখানা আছে ...

"ফলিবেই ফলিবে" ...



এই যে পাবলিক হেলথ-এর ' না জানা পাবলিক উদুম ডিপ লার্নিং আর কার্ভ ফিটিং করে রোজ সকাল-বিকেল দশটা কোভিড-১৯ ফোরকাস্টিং এর মডেল নামাচ্ছে, দৃশ্য দেখেই ইহজগত-কে টাটা করতে হবে মনে হচ্ছে !

যে দিকে জিনিষ যাচ্ছে তাতে অনিশ্চয়তা (আন্সার্টেনটি) কিছুদিন পরে উঠেই যাবে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে দোকান হবে মাতৃ মেশিনলার্নিং স্টোরস কিংবা বগলার ব্যাকপ্রপ কর্ণার, উপরে সাইনবোর্ড ঝুলবে সব জ্যোতিষী বারবার, ডিপ লার্নিং একবার” ...

সে যাই হোক, এই প্যানডেমিক মডেলিং-এর হিড়িক দেখে একটা সদ্য-যৌবনের গল্প মনে পড়ে গেলো! আমার আই-এস-আই-এর প্রাণের বন্ধু মাতাল (ভালো নাম গোপন থাকুক) তখন বিবাহযোগ্য ব্যাচেলর। বাড়ির লোকেও স্বাভাবিক ভাবেই উন্মুখ উদবিগ্ন ... তা মাতালের মায়ের সাথে একদিন বাজারে পুরোনো বান্ধবীর দেখা, -কথা-সে-কথায় জানা গেলো সেই বান্ধবীর- একটি বিবাহযোগ্যা কন্যা আছে, এবং সে মডেলিং করে। মাতালের মা হাতে চাঁদ পেলেন, বললেন বাঃ আমার ছেলেও তো সারাদিন মডেলিং- করে ...

শোনা যায়, নির্দিষ্ট দিনে এরপর দুজনের দেখাও হয়েছিলো বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে, কিন্তু মডেলার মডেলকে দেখতে না দেখতেই মডেলার মাতালের মা বলে ওঠেন, না রে বাবা তোর দ্বারা হবে না ...

আজকের এই মডেলার-দের যদিও সেরম কিচ্ছু বলতে চাই না একেবারেই, এটা নিছক-ই একটা গপ্পো!





পুনশ্চ ১ - কেউ ভুল বুঝবেন না, আমার মনে হয় ইন্টার-ডিসিপ্লিনারি কাজ না করলে এরকম সাংঘাতিক প্যান্ডেমিক রোখা সম্ভব নয়, অথবা পরের বারের জন্য প্রস্তুত হওয়াও খুব খুব শক্ত ... তবে একটা বীভৎস পাবলিক হেলথ ক্রাইসিসের আগাপাশতলা না বুঝে এই ঘোলা জলে একটি খ্যাপলা জাল রেডি রাখার চেষ্টা, অথবা নিজের দু-পহার কোডিং স্কিল শো-অফ করা যে কতখানি crass এবং বিপজ্জনক, সে বোধ কিছু ডেটা-চচ্চড়ির হলে ভারি খুশি হই এই আর কি!

হ্যাঁ, এই বাজারে বরং ডানিং-ক্রুগার এফেক্ট নিয়ে এট্টু পড়ে নিন (যার মোদ্দা কথা হচ্ছে যে লোকের নিজেদের বিদ্যে-বুদ্ধির দৌড়, তাদের নিজেদেরই সচরাচর বোধগম্য হয় না!

পুনশ্চ আমার সব গল্প- অতিরঞ্জিত (নাহয় নির্জলা আর্বান লিজেন্ড)এটাও ব্যতিক্রম নয়তবে একটু রঙ না চড়ালে জীবন বড়োই মান্ডেন ...


Monday, February 17, 2020

কেন?


A crowd flowed over London Bridge, so many,. I had not thought death had undone so many. 


এক-একদিন মনে হয় এই যে একটা বাচ্চা পুঁচকি কুকুরছানা আমার গন্ধ শুঁকে শুঁকে  খুঁজে বেড়াবে আর ওকে কেউ-ই কোনোদিন বুঝিয়ে বলতে পারবে না কিছুই,
সেই জন্য,
আমার মা এই যে রোজ ঠাকুর-ঘরে পুজো দিতে দিতে ভাবেন ঠাকুর এইবারে - এইবারে মুখ তুলে তাকাবেন এই সংসারের উপর, সেই শেষ পুজোর কারণটুকু কেড়ে নিতে ইচ্ছে করে না,
সেই জন্য,
একদিন একটা বন্ধু হয়তো ভুলে যেতে-যেতেও, হঠাৎ ফিরে এসে বলবে 'চ' একটা কাউন্টার খাই', তার সাথে একটা সিগারেট অনেক চুম্বনের থেকেও দামী ছিলো,

সেই জন্য ...

আর আমাদের সোনাঝুরির জন্য ...

একদিন এই জলের দাগ, কাশির শব্দ, আর শেকলের আওয়াজ শুনে শুনে সে পথ চিনে এখানে আসবেই আসবে, হাতে একটা নোংরা পুতুল নিয়ে

হয়তো সেই জন্যেও ...



(কৈফিয়তঃ- 'কেন?' অর্থাৎ এই যে আমি হেঁটে যাচ্ছি, এক ব্যর্থতা থেকে আরো গভীরতর ব্যর্থতার দিকে, কেন? আমি বারংবার নিজের কাছে ফিরে আসি, নিজের বেড়ে চলা ক্ষতের কাছে অসহায় দু-দন্ড বসি, আর দুই হাত দিয়ে প্রাণপণে কান চেপে শুন্যতার অসহ্য শব্দ থেকে নিজেকে বাঁচাই ... তবুও কেউ ঠিক কানে কানে জিগ্যেস করেই চলে, "কেন?")

১৭-ই ফেব্রুয়ারী, ২০২০