Monday, January 14, 2013

আমার শহর



( ভেবেছিলাম এক কাপ চা নিয়ে গিয়ে বাইরের বেঞ্চটায় বসবো, আর আয়েশ করে সিগারেট খেতে খেতে কলকাতার কথা ভাববো খানিকক্ষণ, তারপর এসে একটা পাঁচমিশেলী গল্প নামিয়ে দেবো ... বাধ সাধলো বাইরের বিচ্ছিরি কনকনে হাওয়া আর বরফ-বৃষ্টি, ইন্ডিয়ানা যে কোনোদিক থেকেই ইন্ডিয়া না সেটা আরেকবার উপলব্ধি করে ন্যাজ গুটিয়ে পালিয়ে এলাম ঘরে, আর খানিক রেগে মেগেই এই চিঠিখানা লিখে ফেললাম তাকে ... কলকাতাকে) ... 

উনিশ-শো নব্বুইয়ের আশেপাশেই হবে বোধহয় সময়টা, দুলে দুলে সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে মুখস্থ করছি জাতীয় পশু বাঘ, জাতীয় পাখি ময়ূর, দেশের রাজধানী দিল্লি - বাবা হঠাৎ আনন্দবাজার থেকে চোখ সরিয়ে বললেন, জানিস তো অনেকদিন আগে আমাদের কলকাতাই দেশের রাজধানী ছিলো ... দুষ্টু ইংরেজগুলো কলকাতা থেকে রাজধানী নিয়ে দিল্লী চলে যায় ... ওইটুকু বয়সেও সেদিন খুব কষ্ট হয়েছিলো, ঠিক করেছিলাম বড় হলেই দিল্লীওয়ালাদের সাথে হেব্বি ঝগড়া করে ক্যাপিটাল নিয়ে চলে আসবো ... সেই থেকেই রোজ খবরের কাগজে আর টিভিতে খুঁজতাম, কোথায় কলকাতা টেক্কা দিয়েছে অন্য সব্বাইকে আর যেই টিভিতে বেজে উঠতো 'মিলে সুর মেরা তুমহারা', অপেক্ষা করতাম লাস্ট সিনটার জন্য ... ওই তো কলকাতা, ওই তো পাতাল রেল ... 

নব্বুই থেকে চলতে থাকলাম দুহাজারের দিকে, সাধারণ জ্ঞানের বই থেকে কলকাতা তখন ফুটবল মাঠ, মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গলকে হারালে দুয়ো দিতাম ক্লাসের ধ্রুব, সৈকতদের কিন্তু সালগাঁওকরের জালে যখন বল জড়িয়ে যেতো বাইচুঙের পা থেকে, আঃ সে কি আনন্দ ... কলকাতা আফটার অল ... কেঁদেওছি খুব, সেই যে ছিয়ানব্বইয়ের সেমিফাইনাল ... এখনও চোখ বুজলে দিব্যি দেখতে পাই একটা ওয়াইড বল মারতে গিয়ে বোল্ড হয়ে গেলো তেন্ডুলকর আর বাবা চুপিচুপি ছাদে চলে গেলেন একা একা বসে থাকবেন বলে, আর একটু পর যখন মাঠ থেকে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে বেরোচ্ছে কাম্বলি - গোটা পাড়া তখন অন্ধকার, অবুঝ ... 

তখনো কিন্তু কলকাতা একটা ঠিকানা-চিহ্নই, বার্থ মার্কের মতন সঙ্গে নিয়ে চলি ... বন্ধুত্ব হলো মিলেনিয়াম পেরিয়ে - সেই একদিন জমানো টিফিনের পয়সা খরচা করে উড়িয়েছিলাম এক প্যাকেট উইলস ফ্লেক, একটা ছোট্ট পুকুর পাড়ে বসে আমার প্রথম ক্ষতে হাত রেখেছিলো সেই বয়ঃসন্ধির কলকাতা। আমার দমদমের বাড়ি থেকে সেই বরানগরের ইস্কুল - 'আধ ঘন্টা কি করে ইটারনিটি হয়', শেখালো সেই শহর কলকাতাই ... 

ষোলোয় ভর্তি হলাম দক্ষিণ শহরতলির আবাসিক কলেজে, কলকাতা মানে তখন শনি-রোববারের একচিলতে ছুটি আর ব্যাগ-কাঁধে কোচিং ক্লাসে দৌড়োনো ... দৌড়োতে দৌড়োতেই চিনে ফেললাম শ্যামবাজারের মোড় - চিনলাম গোলবাড়ি, চিনলাম ফড়েপুকুরের গলিতে-ঘুঁজিতে ক্যাসেটের দোকান আর লুকিয়ে লুকিয়ে মিত্রা, প্রাচী, দর্পণা ... কোনো এক শুক্রবার কলেজ কেটে ছুটলাম 'দেবদাস'-এর কান্না দেখতে, দশকা বিশ টিকিটে কয়েক বালতি চোখের জল ফেলে যখন ফিরছি, পকেট তখন ইডেনের টেস্ট গ্যলারি ... হাঁটতে হাটঁতে সেদিন আবিষ্কার করলাম একটা অন্য কলকাতার ছবি - ধুলোবালি আর একরাশ স্বপ্ন মেখে ঘুম যাওয়া শৈশবের ছবি, আর সেই স্বপ্ন মাড়িয়ে দাঁড়ানো নতুন নতুন দেশলাই বাক্সের মতন বাড়ির ছবি ... 

তারপরের গল্প কেমন যেন আবছা সাদা-কালো ... সেই ফুটপাথে হাটঁতে হাঁটতেই চলে গেলাম পার্ক স্ট্রীট - ম্যাগ্নোলিয়ার পাশে সেই প্রথম দেখলাম থরে থরে সাজানো ডানহিল, মার্লবোরো, ক্যামেল ... অলি পাব এলো, বিফ স্টেক আর বিয়ার ... এক বান্ধবীর জন্মদিনে শিখলাম নাহুম সাহেবের পিয়ানোর মতো নকশা করা কেক ... একদিন হুট করে অ্যাকাডেমিতে গিয়ে দেখে ফেললাম 'নানা রঙের দিনগুলি' - মনে হলো বাকি জীবনটায় আর কিছু করি না করি একটা ঠিকঠাক নাটক লিখবো, সেই নাটকের প্লট খুজঁতে খুজঁতে চলে গেলাম কতো কতো জায়গায় কে জানে - সেই পুরোনো অন্ধকার রেলরোডের ধার থেকে হাঁটতে হাঁটতে রতনবাবুর ঘাট, শেষমেষ গল্প খুঁজে পেলাম একটা বৃষ্টিভেজা ফুটবল মাঠে। 

গল্পের টানেই গল্প আসে, আসে একটূ একটু বৃষ্টির ছাঁট আর নেশার রাত্রি ... ময়দানের রেসের ঘোড়াগুলোর থেকেও জোরে ছুটতে থাকে ফুরোতে না-চাওয়া শহরের গল্প, আর হাফ-ওপেন স্কাই খালাসিটোলার ছাদে আস্তে আস্তে মিলিয়ে যায় মুখগুলো একটা একটা করে ... 

আমার শহরের গল্প সেইখানেই আটকে গেছে, আমিও ...  মাস ছয়েক পরের এক রোববারে লুফতহান্সায় চড়ে পাড়ি দিই মুম্বই আর তার এক বছর পরে আর্ধেক পৃথিবী দূরে আম্রিকার শহরতলি ... কলকাতাকে দূর থেকে দেখি, আনন্দবাজার পড়ে এখনও উত্তেজিত হয়ে উঠি ... হঠাৎ কোনো খবরে পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করে কাউকে হয়তো ... সিনেমার মতন দূর থেকে হাল্কা হাল্কা শহরের গলা কানে আসে, সেই ছোট্টবেলার কারখানার ভোঁ, এরোপ্লেনের আওয়াজ, 'চাষীভাইদের বলছি' আর সন্ধ্যে সাতটার বাংলা খবরে মস্ত টিপ পড়া সেই মহিলার গলা ... 
গোদার বলেছিলেন না, 'সব গল্পেরই একটা শুরু, শেষ আর মধ্যিখান থাকে - হয়তো তারা পরপর আসে না' ... আমার শহরের গল্পেরও নিশ্চয়ই আরেকটা  শুরু লুকিয়ে আছে কোথাও, বা একটা অন্যরকম মাঝের পাতা ... 
অপেক্ষায় আছি, থাকবো সারাজীবন ...