Saturday, October 22, 2016

সেই ছিলো এক দিন আমাদের


আমার পুরো ছোটোবেলা জুড়েই বাড়িতে একটা দারুণ ব্ল্যাক-অ্য্যান্ড-হোয়াইট টিভি ছিলো, আপট্রন কোম্পানির - তার সঙ্গী ছিলো ছাদের উপর একটা নড়বড়ে অ্যান্টেনা, তাতে কাক-পায়রা একসাথে বসে পাড়া পাহারা দিতো, আর মা বলতেন বাইরে বাজ চমকালেই দৌড়ে গিয়ে টিভি অফ করে দিতে - বজ্রবিদ্যুত-সহ বৃষ্টি  না হলে ওই অ্য্যান্টেনা বেয়ে টিভিতে ঢুকে পড়বে যে কোনোদিন। সত্যি বলতে কোনোদিনই জানা হয়ে ওঠেনি, সত্যি ওর'ম হয় কিনা, তবে এখনো বাইরে বাজ-টাজ পড়লে অল্প-স্বল্প ভয় করে ওঠে।

আপট্রনের কৈবল্যপ্রাপ্তি আর কোনোদিনই হয়নি - শুধুই ডিডি ওয়ান, ডিডি টু আর মাঝে মাঝে টিভির কানটা আরো বেশ কয়েক ঘর মুলে দিলে ঝাপসা করে ডিডি থ্রি। আমাদের পাশের ঘর ভাড়াটেদের আবার বাংলাদেশের লাইন ছিলো, মাঝে মাঝে বিকেলের মলয় বাতাসে দুই অ্য্যান্টেনায় ঠোকাঠুকি লাগলে দিব্যি ঢাকার খবর শুনতে পেতাম, কিস্যু বুঝি আর না বুঝি - বেশ খানিকক্ষণ হাঁ করে দেখে নিতাম, এখন যেমন জুপিটারে নাসার পাঠানো প্রোবের তোলা ছবি দেখি অবাক বিস্ময়ে ...

ঠিক মাঝের ঘরে একটা মান্ধাতার আমলের পুরোনো টেবিল ছিলো, তার উপরে রামকৃষ্ণ-সারদা-বিবেকানন্দের ছবি আর দুটো সাদা ফুলদানির মাঝে জ্বলজ্বল করতো আমাদের আপ্ট্রন, মাথায় মায়ের বোনা নক্সা-করা কভার পরে। আর তার চিরসাথী ছিলো তাপসদা, পাড়ার বেকার যুবক, এদিক-ওদিক অ্যাপ্লাই করে বেড়ানোর ফাঁকে ফাঁকে পড়শিদের বাড়ি বাড়ি টিভি আর রেডিও সারাতো। মধ্যেমধ্যেই মাস ছয়েক কেঁপে কেঁপে, বাবার হাতের চড়-থাপ্পড় খেয়ে যেদিন আপট্রন দেহ রাখতো, আমার উপর হুকুম পড়তো - সারা পাড়া ঘুরে কোনো একটা রকের আড্ডা বা ক্যারমের বোর্ড থেকে তাপসদাকে ধরে আনা ! গাঁইগুঁই করতে করতে তাপসদা আসতো, সারাদিন লেগে থেকে সন্ধ্যে সাতটার খবরের ঠিক আগে টিভি আবার জেগে উঠতো কি করে যেন, তাপসদা কি কি চার অক্ষর বলতে বলতে রকের আডডায় ফিরতো তা জানিনা, তবে আমি ভাবতাম লোকটা নির্ঘাত ম্যাজিক জানে ... শেষের দিকে তাপসদা আর টিভি কেমন মায়ার বাঁধনে জড়িয়ে গেছিলো, বিকেলে ঘুরতে ঘুরতে তাপসদা চলে আসতো বাড়িতে, চা খেতে খেতে টিভির পেছন খুলে কিসব চিপ-ফিপ লাগিয়ে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে যেতো, পয়সাও নিতো কিনা কে জানে, সেদিন রাতে আপট্রনের আওয়াজে যেন একটু জোর পেতাম ...

প্রাইমারী থেকে সবে সেকেন্ডারি উঠলাম, বিকেলে বাড়ি ফিরতাম স্কুলে বকুনি-প্যাঁদানি খেয়ে, কোনো-কোনোদিন আবার খাতায় গার্জেন-কলের চোখরাঙানি - ফিরেই মেট্রো চ্যানেলে শুরু হতো সুপার-হিউম্যান সামুরাই, সে এক অন্য লেভেলের ফিউচারিস্টিক শো, কম্পিউটারের তার বেয়ে কিছু ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া বাচ্চা গিয়ে ডাইনোরূপেণ সংস্থিতা ভাইরাসদের কেলিয়ে আসতো, আমার বাংলা মিডিয়ামের বিদ্যেয় তাদের কথাবার্তা বুঝতাম না, কিন্তু ক্যালাকেলি দেখতাম রসিয়ে-রসিয়ে ... গোগ্রাসে গিলতাম মহেশ ভাটের টার্নিং পয়েন্ট, আর মানেকা গান্ধীর শো 'হেডস অ্য্যান্ড টেলস', যার একটা এপিসোড দেখে প্রায় এক বছর নিরামিশাষী হয়ে গেছিলো সেই দশ-বারো বছরের আমি !

এসব হলো গিয়ে সেই শেষ নব্বুইয়ের কথা, তখনও জীবনে দফা ৩০২ আসেনি, ডেবোনেয়ার তখনও কীটসের কবিতার মধ্যে লালকালিতে দাগানো একটা শব্দ, যার মানেটা দিদিকে জিগ্যেস করে নিতে হবে একদিন - সেই সময় আমার জীবনে নিষিদ্ধ আনন্দের জানলা ওই ব্ল্যাক-অ্য্যান্ড-হোয়াইট আড়াই চ্যানেলের বোকাবাক্স। সেও এক রোমহর্ষক অ্য্যাডভেঞ্চারের গল্প। ওদিকে বিষ্যুদবার পৌনে আটটা বাজবো, বাজবো করছে - বাবা মুখের সামনে আনন্দবাজার বা লাইব্রেরী থেকে আনা শঙ্কু মহারাজের ভ্রমণকাহিনী ধরে একটার পর একটা সিগারেট টানছে আর মা রান্নাঘরে তিন-চারটে রোবিন্দোসঙ্গীত আর অতুল্প্রসাদী ম্যাশ-আপ করে একটা মেলোড্রামাটিক ভজন গাইতে গাইতে রুটি বেলছে, আমার আর দিদির তো আর বীজগণিতে মন নেই, চিত্রহারে নিশ্চয়ই এতক্ষণে আর্ধেক শেষ - এমনি সময় deuce ex machina-র মতন অব্যর্থ কলিং বেল, নিতাইকাকু ওষুধ নিতে এসেছে - অর্থাৎ বাবার থাবা মিনিট দশেকের জন্য অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে - সত্যি বলছি, ঐ যে শেষ হতে হতে, কোনোরকমে ভল্যুমটা আস্তে করে লাস্ট দুটো গান শুনে নেওয়ার যে তৃপ্তি, টাকা দিয়ে কনসার্টে গিয়েও পাইনি আর কোনোদিন ...

বাবা ঠিক করে দিতেন কোনগুলো বাচ্চাদের উপযুক্ত শো, আর কোনগুলো এক্কেরে নৈব-নৈব চ, যেমন ধরুন আপনি রোববার সক্কালে টিভি খুলে বসে গেলেন, টেলস্পিন চলেগা, ডাকটেলস-ও চলেগা, কিন্তু চন্দ্রকান্তা-কি-কাহানি? নোপ ! ওদিকে মহাভারত, রামায়ণ, স্বপ্নিল যোশির শ্রীকৃষ্ণ চলতে পারে, মাঝদুপুরে জননী, সন্ধ্যে পড়লেই জন্মভূমি, কিন্তু সি-হক্স দেখলে চ্যানেল ঘুরিয়ে দেওয়া হবেই হবে, আর সুপারহিট মুকাবিলা? ভাবাই যায় না ... সে যখন নাম পালটে হয়ে গেলো আওয়াল নাম্বার, লুকিয়ে-চুরিয়ে দেড় মিনিটের গান শোনার আশায় কত মিনিট যে বাবা সায়গলকে সয়েছি, ভাবলে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে ...

তাও বিদ্রোহ তো হতোই, নীলাঞ্জনা যদি নচিকেতার হন, আমার তবে নিকি অনেজা, আর দিদির তবে আধাআধি করে এদিকে রাঘবন, ওদিকে ক্যাপ্টেন ভ্যোম, মিলিন্দ সোমান। আর বিকেল হলে মা যখন একটু গড়িয়ে নিচ্ছে, সেই ফাঁকে অকথ্য বাংলায় ডাব করা সোওয়াভিমান ... প্লটের মাথামুন্ডু কিচ্ছু বুঝতাম না, হাঁ করে কিটু গিদোয়ানিকে দেখতাম ...

রোব্বারের বিকেলে বাংলা সিনেমাটা চলতো বটে, মাঝেসাঝে পাড়ার দু-একটা কাকা-জ্যেঠা শুদ্ধু হই-হই ব্যাপার, তবে সেন্সর-সমেত, যেই না বৃষ্টির রাত্রে দেবশ্রী ছাদে উঠে গান ধরলেন, 'আর কত রাত একা থাকবো?', বাবার চোয়াল অমনি কঠিন হলো, আর তক্ষুণি জানা গেলো শীতলা-মন্দিরের পাশে চপ ভাজা হচ্ছে, দু মিনিট দেরি হলেও একটাও কচুরি থাকবে না আমাদের জন্য ...

যে দুটো জিনিষ এইসবের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতো অক্ষত দেহে, একটা হলো খেলা, আর এক ছিলো ডিটেক্টিভ সিরিজ, আর ছিলোও সেসব দারুণ দারুণ, কুচো বয়সে রজিত কাপুরের ব্যোমকেশ, তারপর এলো শেখর সুমনের রিপোর্টার, সুদেশ বেরির সুরাগ ... সুরাগ কিন্তু এর মধ্যে একটা মাস্টারপিস, যারা দেখেননি, তারা জানেনও না সে কি জিনিষ, সুদেশ বেরি ঠিক লাস্ট মোমেন্টে এসে খুনীকে ধরবেন, আর ধরার পরেই সেই মুখের সবকটা মাসল কাঁপিয়ে সেই অমর ডায়লগঃ দিস ইস চেক, মেট !

বাংলাও অবিশ্যি পিছিয়ে ছিলো না, দুপুরের দিকে হতো এক-শুন্য-শুন্য, আর সপ্তাহে একদিন (?) রাত্রে 'আবার যখের ধন', যাতে আবার একটা গোরিমান-টাইপের কস্টিউম পরা ঘটোৎকচ এদিক-ওদিক ঘাড় মটকে বেড়াতো, আর দ্বিজেন বন্দ্যো যেই বলতেন 'বিমলবাবু ভাই', সব্বাই হেসে গড়িয়ে পড়তো ... (অনেক, অনেক পরে বাংলায় একবার ব্যোমকেশ হয়েছিলো, সুদীপ মুখার্জীকে দিয়ে, সে যাকে বলে চাঁদেও দ, আর পোঁদেও দ, দেখতে দেখতে মনে হতো দিই এক ঠাস করে !), আর ছিলেন পঙ্কজ রায়, বিকেলে আসতেন দর্শকের দরবারে, আর সেইসব একলা বৈশাখের দিন নববর্ষের বৈঠক নিয়ে ...

এর মধ্যে কোত্থেকে যেনো হুহু করে বাজারে ছেয়ে গেলো কেবল লাইন, আর সে 'অনির্বচনীয় হুন্ডি শুধু দু-একজনের হাতে' ... স্কুলের বাসেই তখন আসল ক্লাসটা হয়, যাদের কেবল, তাঁদের কারুর কারুর আবার কুল বাপমা, বাসে যেতে যেতে সবাই জুলজুল করে শুনতাম রাত্রে রেন্দেজভ্যুস-এ সিমি গারেওয়াল কি কি বল্লেন, আর জি-তে কি সিনেমা আসবে সে সপ্তায় ...

আস্তে আস্তে বড় হতে লাগলাম, আমি আর সব বন্ধুরাই, নাইন-টেনে উঠতে উঠতে বুঝলাম, ডিডি-১ আর ২ ততদিন ডাইনোসরের প্রপিতামহ, বন্ধুরা বড়দের সামনে ইএস্পিএন, ডিসকভারি, ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক এবং আড়ালে এফ-টিভি আর রেন টিভির গল্প করতো, আগের সপ্তাহে কারা লুকিয়ে বেওয়াচ দেখেছে, আর আমরা, বাকিরা টিভির দোকানের সামনে জমা ভিড়কে জিজ্ঞেস করে নিতাম, 'দাদা, ক'টা উইকেট পড়লো?', আর পরের দিনের আনন্দবাজারে খেলার পাতাটা পড়তে পড়তে ভাবতাম একদিন শালা আমাদেরও দিন আসবে ...

আমাদেরও দিন এসেছিলো, তবে কেবল লাইন দিয়ে নয়, সেই দুরদর্শনেই, সে এক আশ্চর্য schadenfreude, নরেন্দ্রপুরে ঢুকে দেখলাম বড়োসড়ো খেলা বাদে টিভি চলে না, খালি একচিলতে রোদ্দুর, শুক্রবারের রাত, একবাটি মাংসের ঝোল, আর একটা হিন্দি সিনেমা - এক গোটা হোস্টেল একটা পঁচিশ ইঞ্চির টিভিতে হাঁ করে সুনীল শেঠঠির 'ভাই' কি সানি দেওলের 'ঘায়েল' দেখছে, এমনকি চোর চুরি করতে এসে বোঁচকা পাশে রেখে হাত্তালি দিয়ে উঠছে, এ দৃশ্য যদি দেখতে চান, চলে আসুন কলকাতা - ১০৩!

টিভির সাথে সম্পর্কটা সেখান থেকেই আস্তে আস্তে ফুরিয়ে গেলো, নরেন্দ্রপুর শেষ করলাম, আই-এস-আইতে এসে দেখলাম একটা টিভি লাউঞ্জ আছে বটে, তবে কেউ না কেউ সবসময়ই বসে কিছু না কিছু  খেলা দেখে - আর কখনো কখনো বনহুগলির মোড় থেকে ভাড়া করে আনা সিডি। এক বন্ধুর কাছ থেকে ফ্রেন্ডস দেখা শিখলাম, দেখলাম কেউ মজার কথা বল্লেই নেপথ্যে হাসির রোল পড়ে যায়, কেমন জানি কথামৃত মনে পড়ে গেলো, ঠাকুর বসে পিজে মারলেই যেখানে শ্রীম ব্র্যাকেটে লিখে দেন "পার্ষদবৃন্দের হাস্য" ... আর যে গার্লফ্রেন্ড ছিলো তখন, তার বাড়িতে গেলেই দেখতাম একঘরে তার মা বসে কিউঁকি দেখছেন, আরেক ঘরে তার বাপ বসে সিএনবিসির ফুটনোট !

তারপর সে যেন কয়েকশো বছর পেরিয়ে গেলো কি করে, সিনেমায় নামার শখ চেপে চেপে একদিন একটা স্টেজে উঠে পড়লাম, দেখলাম উইংসের ধার থেকে কেমন মায়ামাখানো লাগে অডিয়েন্সের আবছা অস্তিত্ব, সে এক অন্য বসন্ত আমাদের - কমল্কুমার এলেন জীবনে, ক্রমে আলো এলো, আগুন, মুখোশ, পরচুলা ইত্যাদি নিয়ে  এলেন সন্দীপন, একদিন একটা রিহার্সালে গৌরবদা অ্য্যাক্টিং করতে করতে মেঝেয় ঠুকে পাটাই ভেঙ্গে ফেললো - নাটক-ক্লাব শুরু হয়েও বন্ধ হতে হতে, পড়লো আমাদের হাতের তালুতে ... টিভি তখন সময়-নষ্টের নামান্তর !

এই তো পরশুদিন ভারত ক্রিকেটে একদম লাস্ট ওভারে গিয়ে হেরে যাওয়ার পর এক জুনিয়রের পোস্ট দেখে মনে পড়লো দশ, না কুড়ি বছর আগের এক রাতের কথা, ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়া-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ, আমাদের সব ব্যাটসম্যান আউট, মা-বাবা মন-খারাপ করে বাইরের ঘরে বসে আছে যাতে টিভিতে হেরে যাওয়াটা দেখতে না হয়, আমার তো বৃথা আশা মরিতে মরিতেও মরে না ... এমনি সময় জ্বলে উঠলেন কুম্বলে আর শ্রীনাথ, স্টিভ ওয়া-র বলে একটা বিশাল উঁচু শট আর অম্নি আপ্ট্রন অন্ধকার, আমার চিৎকার শুনে বাবা দৌড়ে এসে এক চড় কষালেন টিভির পাশে, আর একটা বিশাল ছক্কা গিয়ে পড়লো চিন্নাস্বামীর গ্যালারিতে, আহ নস্ট্যালজিয়া !

তারপর অনেক কষ্টেও মনে করতে পারলাম না, শেষমেশ কি হলো সেই টিভিটার? তাপসদাই কি শেষে একদিন এসে নিয়ে গেছিলো না সকাল আটটার কর্পোরেশনের বাঁশির আওয়াজে একদিন রাস্তার ধারে নামিয়ে দিয়ে এসেছিলাম আমি-ই? মনে পড়লো না! মনে পড়লো তাপসদাকে দেখে দেখে আমার বাবাও টিভির কলকব্জা শিখে গেছিলেন দিব্যি, মাঝে মাঝে একটা ইস্ক্রুপ ড্রাইভার নিয়ে টিভি খুলে বসে পড়তেন, ঠোঁট থেকে ঝুলতো উইলস ফ্লেক! আমরা তখন মনে মনে প্রমাদ গণতাম ... এই গেলো বুঝি !

সত্যি বলতে গেলে খুব রাগ হতো, পাশের বাড়ির টুব্লুদাই কেবল টিভির ডিস্ট্রিবিউটার, তাও নেবে না -
ওরা অবশ্য ভাবতো ওইটা নেই বলেই না আমরা ফি বছর ব্যাগভর্তি নম্বর নিয়ে বাড়ি ঢুকছি আর দেশের-দশের মুখ উজ্জ্বল করছি -

বললে পেত্যয় যাবেন না, দেশের নাহক পাড়ার মুখ প্রায় উজ্জ্বল হয়ে গেছিলো আরেকটু হলেই, সেবার জয়েন্টে নরেন্দ্রপুরের সবাই স্ট্যান্ড-ফ্যাণ্ড করে ফাটিয়ে দিয়েছি, আর চ্যানেলে চ্যানেলে বেমক্কা ব্যাচের লোকজনের ইন্টারভিউ দেখাচ্ছে - অনেকক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরিয়েও আপট্রন সেদিন কিছুই দেখালো না, সন্ধ্যে ছটার খাস-খবর খুলেই লাফিয়ে উঠলো বাবা, কিন্তু টাইটেলেই যে টাইপো - দত্তকে কে যেন দানা করে দিয়েছে, একবার নয়, দু-দুবার !

ছানার শোক, না দানার শক কোনটা বাপের গায়ে বেশী লেগেছিলো সে জানিনা, কিন্তু আপ্ট্রনের গল্পের ইতি সেইখানেই ...


Sunday, October 9, 2016

ইস্কুলের গল্প - ১

(শীর্ষেন্দু একজায়গায় লিখেছিলেন, 'মানুষ মরে গেলে ভুত হয়, আর ভুত মরে মার্বেল হয়', তেমনি আমাদের অনেক মুখচোরা, ভয় পাওয়া ইচ্ছেরা মরে তৈরী হয় এক-একটা মন-কেমন করা বিকেল, আর বিকেলগুলো মরে কী তৈরী হয় জানো? 
             বাজারের থলে দেখেছো? উল্টোলেই একটা দুটো পেয়াঁজের খোসা কোত্থেকে ঠিক বেরিয়ে পড়বে, সেইরকম কতগুলো জিনিষ কেমন করে যেন আলগা হয়ে লেগে থাকে আমাদের সাথে, কবে এসেছিলো জানিনা, আবার কোনদিন ঝাড়তে গিয়ে বেরিয়েও যাবে, তাই গল্পগুলো এইবেলা লিখে ফেলা ভালো।)


আমরা যে স্কুলটায় পড়তাম, তার নাম বরাহনগর মিশন, এবং তার নামকরণ যে সার্থক একথা কেউ কোনোদিন অস্বীকার করবে বলে মনে হয় না, যদিও সরকারী বানানে 'হ'টা বেমালুম উড়ে গেছে কাউকে না বলে - আমাদেরও তাই আর কিছুই হয়ে ওঠা হয় নি শেষমেশ। তা এই বরানগর স্কুলে ওয়ান থেকে টেন অব্দি ক্লাস, প্রথম পাঁচটা ক্লাস ভেতরে প্রাইমারি, শেষের পাঁচটা সামনের খেলার মাঠের পাশেই, বি-আই কোম্পানির সঙ্গে পাচিঁল ভাগাভাগি করে। দিব্যি ছিলো স্কুলটা, পাড়াতেই রাজকুমারী স্কুল, আর রোজ সকালে ঠিক দশটা বাজতে দশে সামনে দিয়ে এক এক করে বাসগুলো যায়, একটা মাল্টিপারপাস, একটা নিবেদিতা, আর ফেরে বিকেলে ছুটির পর ... ছেলেদেরও ওই দুবার শারুখখানী পোজ দিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ানো ছাড়া খুব একটা জীবনে খুব যে আর বেশী উদ্দেশ্য-বিধেয় ছিলো এমন ভাব্বার সত্যিকারের কোনো কারণ নেই, তো মোট কথা দিব্যি ব্যাপারটা চলতো আস্তে আস্তে, ফিসফিস করে, যেমন সব ছোট্ট শহরতলিতে হতো সেই নব্বুইতে। সেই সাইকেল করে টবিন রোডের কাছে কোচিং, তার পাশেই জেরক্সের আর একটু এগোলে চপ-ফিশফ্রাই-এগরোলের দোকান -- আর দোকানের পাশে মাঠ, "ছুটির বৈঠক"। ঠিক এই সন্ধ্যে ছটার সময় যদি যান, দেখবেন আলোগুলো আজকেও কেউ জ্বালতে ভুলে গেছে, এদিক ওদিক দূরে দূরে, ঠিক যতটা দূরে বসলে আর কথা বোঝা যায় না তেমনি দূরে কয়েকটা জমাট বাঁধা অন্ধকার। আমরাও আসুন একটা সাইড দেখে একটা সান্ধ্য আজকাল পেতে বসে পড়ি, সিগারেটও আছে, ঘটিগরমের লোকটাও আসবে এক্ষুনি, আমরা বরং হাঁটতে হাঁটতে ফিরে যাই সেই অবুঝ, অস্পষ্ট, অন্ধকার রাস্তাটায়, যার নামটা সবাই ভুলে গেছে, ল্যাম্পপোস্টের আলোয় খালি নম্বরটা পড়তে পারছিঃ  ১৯৯৯।


সেই সময় স্কুলে একসাথে দু-দুটো ঘটনা ঘটলো। এক নম্বর, বলা-নেই-কওয়া-নেই দুম করে স্কুলে একটা ওয়ার্ল্ড রেকর্ড হয়ে গেলো, বোর্নভিটা অ্যাকাডেমির কাছে স্কুলের টিম গিয়ে শুন্য রানে অল আউট হয়ে ফিরে এলো - আর তাকে সামাল দিতেই হবে হয়তো, একটা গোবেচারা-পানা ছেলে গাঁতিয়ে পড়ে মাইধ্যমিকে ফার্স্ট হয়ে গেলো (আমার ধারণা ছায়া প্রকাশনীর আদি-অকৃত্রিম পোস্টার বয় সেই, যদিও আমার গেঁজেল মেমোরি যা চায়, ইতিহাস তাই নয়)। তা এসব মহাজাগতিক ঘটনা চাক্ষুষ-টাক্ষুষ করে কয়েকটা জেনারেশন বাপ-মার মাথাটা গ্যালো বিগড়ে। হঠাৎ সবাই বুঝলো যে সাফল্যের চাবিকাঠি খুজঁতে আর টর্চ লাগবে না, এক্কেবারে হোলসেলে কিলো-দরে পাওয়া যাচ্ছে যোগেশদা-দিব্যদা-সুদীপ্তদার আখড়ায়। আমার বাপ-মা, অর্থাৎ আমি, যে এই রেনেঁশায় এক্কেবারে দুম করে গিলোটিন হয়ে গেছিলাম তা নয়, তবে অচিরেই দেখলাম স্কুলের পরে বাড়ি গিয়ে আর সাতটা পয়ঁতাল্লিশের চিত্রহার নেই, আছে হুড়ুদ্দুম করে 'অভাগীর স্বর্গে'র নোট টোকা। এমনকি রোববার সকালেও যে জম্পেশ করে চন্দ্রকান্তা কি কাহানি দেখবো আর ক্রূর সিং কে খিস্তাবো, সে গুড়ে বালি, চুন ও সুড়কি। পি আচার্যের ভাষায় আমার দুর্যোগে তখন ঘনঘটার ভাগ্যাকাশ, কিন্তু ঠিক এই সময় একজন দারুণ লোকের সাথে আলাপ হয়ে গেলো, তার কোচিং-এ পড়তে গিয়েই - ভদ্রলোকের নাম সুভাষদা, সুভাষ মুখোপাধ্যায় - নাঃ সেই কবি সুভাষ নন, যিনি ফুল খেলবার দিন নয় বলে অদ্য মেট্রো স্টেশন হয়ে গেলেন, তবে এই গল্পটা ইনি না হলে হতোই না হয়তো ...


সুভাষদা ঠিক কেমন ছিলেন বলে বোঝানো অসম্ভব, একটা গোলগাল পরিতৃপ্ত চেহারা, মাথায় একঝাঁক কোঁকড়া চুল, আর সত্যিকারের উদাত্ত গলা ... সবথেকে বড়ো ব্যাপার, প্রথম দিন-ই ক্লাসের পর ডেকে বললেন বইয়ের ওসব বাজে কবিতা না পড়ে এসো আমরা টি এস এলিয়ট পড়ি, আর রিলকের দুইনো এলেজি ... আর শুধু ওই 'যদু হে, মাছ কিবা'র ভাব সম্প্রসারণ না করে, চলো বইটাই পড়ে ফেলি ... এখন যখন পিছনে তাকাই, মাঝে মাঝে সেই বিকেলটার কথা মনে পড়ে, জয়েন্টের রেজাল্ট বেরোনোর পরের দিনই, সুভাষদার বাড়ির ছাদে আমরা বসে চা খাচ্ছি, খুব চুপচাপ, সেই মধ্যবর্তী নৈঃশব্দ - খানিকক্ষণ পরে সুভাষদাই ভাংলেন, "তা তুমি যাদবপুরেই যাবে, সেই একটা টি কাঁধে ঘুরে বেড়াতে, আর গাছতলায় বসে গাঁজা খেতে?" ... উত্তর দিতে পারিনি।


যাহোক, আমি আসল গল্পটার থেকে এদিক-ওদিক বাইলেনে ঢুকে পড়ছি, সেই ছোটোবেলার অভ্যেস তো, চট করে যেতে চায় না, না? তা এই গোটা টাইমটায় আমার একমাত্র অ্যাচিভমেন্ট বলতে গেলে ওই মাঠে দু-একবার সিগারেট খেয়ে দেখা, আর একবার ক্লাস মনিটর হয়েও স্কুল পালানো বন্ধুদের নাম হেডুকে না বলে দেওয়া -- মোটামুটি ঐ বইতে আর নোটসে মুখ গুঁজেই কেটে যাচ্ছিল নাব্য নব্বুই, কোত্থেকে যে দখিন বাতাস ঢুকে একে একে সবকটা বন্ধুরই উইকেট ফেলে দিয়েছে সেটা বুঝতে একটু বেশ দেরি-ই হয়ে গেলো, একদিন দেখলাম কোচিং থেকে বাসস্ট্যান্ড অব্দি সঙ্গে হাঁটার আর কেউ নেই, সিগারেট টাও একাই কিনতে হচ্ছে স্কুলব্যাজ টা পকেটে লুকিয়ে।



নিয়তি দেখেছেন তো, নিয়তি? মাতালকে যা নিয়ে যায় বাংলার বোতলের দিকে, আর ডিপ্রেশানের রুগীকে রেললাইনের ধারে, এই সেই নিয়তি, তা প্রেমে আমিও ধপ করে পরেই গেলাম, সঙ্গে পড়ার মতন লোকের আর অপেক্ষা না করেই। সে এক দারুণ সময় বটে, যাই দেখি, বয়ঃসন্ধির ব্রণর মতন থেকে থেকেই অল্প বসন্ত জেগে ওঠে, সে কুমার শানুর নাকিগলায় গান শুনে-ই হোক, কিংবা টিভিতে ক্যাডবেরির অ্যাড দেখে। কিন্তু বিধি বাম, 'শুধাইলো না কেহ' ... হঠাৎ এই সময় একদিন দেখি কোচিং-এর পরই একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে গলির মোড়ে, হাত একটা সদ্য কেনা - রাংতাটাও না ছাড়ানো উইলস ফ্লেকের প্যাকেট ...


ছেলেটির আসল নামটা চেপে যাচ্ছি, ধরা যাক ওর নাম সন্দীপ আর ও সেদিন ওই সিগারেটের প্যাকেটটা হাতে যার কথা বলবে বলে দাঁড়িয়ে ছিলো, তার নাম ধরে নেওয়া যাক অমৃতা ... সন্দীপ ভালো ছেলে, বাপে-মায়ে পড়িয়ে-পিটিয়ে মানুষ করছেন, ছেলেও কেসিনাগ-কেপিবোস আর মাইতি-সাঁতরা করে ফি বছর ক্লাসে জ্বলজ্বল করে ওঠে। যদিও বাংলাটা একটু ইয়ে, মানে জয়েন্টে লাগবে না কাজেই পড়ে খুব একটা লাভ নেই যাকে বলে -- তো সন্দীপ এসে বললো যে একটা চিঠি খুব দরকার, যার মূল বক্তব্য হচ্ছে যে ও অমৃতাকে খুবই ইয়ে করে, কিন্তু একটু কবিতা-টবিতা না থাকলে ঠিক ব্যাপারটা জমছে না। আমি তো হাতে স্বর্গ পেলাম (এবং একটা গোটা প্যাকেট ফ্লেক!) ... জানা গেলো, আমি-ই পত্রলেখক ও বাহক, খালি তলায় নামটা আমার নয়। যেমন ফেলুদার গল্পে হয়, সেরকম পারিশ্রমিক, শুরুতে ফ্লেক, মাঝে একটা দুটো এগরোল, আর উঠে গেলে নেভি কাট ...
আমার দৌড় তখন শেষের কবিতা অব্দি, তাও আবার দিদির দৌলতে, যে নিবেদিতায় পড়ার সৌভাগ্যে বোধহয় পুরো বইটাই এপাশ-ওপাশ গাঁতিয়ে ফেলেছে ততোদিনে ... তা শুরতে ভাবলাম অমিত রায়কে টুকলি করে জন ডান ঝেড়ে দিই, (যাকে বলে টুকলি-অব-অর্ডার-টু) ...

"For God's sake, hold your tongue and let me love" ... 

একটা পায়োনিয়ার কোম্পানির ফুলস্ক্যাপ পাতা ছিঁড়ে উপরেই সেটা লিখেও ফেললাম ... কিন্তু কেমন একটা বুকটা ছ্যাঁতছ্যাঁত করতে লাগলো, হাজার হোক - ব্যাঙ্কের কেরাণী মধ্যবিত্ত বাঙালি বাপ, Tongue দেখে পানু ভেবে কেলিয়ে দিলে হয়ে গেলো আর কি ... আবার তন্নতন্ন করে খুঁজলাম শ্যাষের কবতে, এইবার এলো সংস্কৃত -

 'স্মরগরল খন্ডনং মমশিরসি মন্ডনম, দেহি পদপল্লবমুদারম' ... 


লিখেই কেমন একটা সাত্ত্বিক শাহরুখ ভাব এলো, কিন্তু সন্দীপ টিফিনের সময় বললো অমৃতাদের ইস্কুলে হিন্দি অ্যাডিশনাল, সংস্কৃত নাই ... ওসব চলবে না ...

দিন যায়, রাত যায় - এদিকে আমি তো আর যুতসই কবিতা পাই না, প্রথমে গিয়ে ধরলাম পাড়ার একটা পাতাখোর কবিকে, সে আবার সকালে প্রাইমারী স্কুলে পড়ায়, দুপুরে পার্টি অফিসে ম্যানিফেস্টো বিলোয় আর রাত্রে অল্প তন্ত্র-মন্ত্র করবে বলে গাঁজা টেনে 'মা-মাগো' করে আর্তনাদ করে। সে বললে, "প্রেম মানে নীরা, নীরা মানে যে রানীর উল্টোস্রোত, যেমন ধারার বীপ্রতীপ রাধা" ... তখনো 'গুগুল তোমার দারুণ দীপ্তি ফেলেছে জগৎ ঢাকিয়া' টাইপের টাইম নয়, আর পাড়ার নবজাতক লাইব্রেরীতে হেমেন রায় আর সত্যজিৎ ছাড়া কিছু ঢোকে নি কোনোদিন ... অনেক কষ্টে এক বন্ধুর বাড়ি থেকে চুরি করিয়ে আনলাম সুনীলের একটা বই, মলাটে আবার বাড়ির লোককে ধোঁকা দেওয়ার জন্য লেখা 'প্রশ্ন বিচিত্রা' ... সে কবিতাগুলি যে কি ভালো ছিলো কি আর বলবো, সেই যে সুনীল লিখছেন যে তিনি সাবান হয়ে যেতে চান, নীরা তাকে নিয়ে কি কি সব তারপর করবেন ...
নাঃ, নীরা সেই চিঠিতে জায়গা পেলোনা, আমার সাহস-ও যে হয়েছিলো তা নয় ... তবে একদিন 'বুকে বল, হাতে পেশী, কথা কম, কাজ বেশী' করে সুভাষদাকেই ধরলাম ক্লাসের পরে ...

"স্যার, দু মিনিট সময় হবে? একটা সাজেশান চাইবার ছিলো ... "

জীবনে সাজেশান শব্দটাকে সুভাষদা কেনো, আমার ধারণা সব মাস্টাররাই হেব্বি ঘেন্না করে, তবে এই একবার ভদ্রলোক দেখলাম একেবারে উদ্ভাসিত হয়ে উঠলেন, বললেন, "আমার যে গুরু বাংলায়  লিখে আরেকটা পৃথিবী বানিয়ে ফেলেছেন, তাঁরই দু-লাইন বরং তোমাকে বলি, কনিষ্ক ...

"তুমি তো জানো না কিছু – না জানিলে,
আমার সকল গান তবুও তোমারে লক্ষ্য করে" 

...
আমার বুকের ‘পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল,
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই;
শুধু তার স্বাদ
তোমারে কি শান্তি দেবে?"

পুরোটা বলে অনেকক্ষণ বাইরে চেয়ে থাকলেন সুভাষদা, বললেন ধার-দেনা করে বাজারে আলু-পটল কেনা যায়, প্রেমের চিঠি লেখা যায় না। 

            সেদিন রাত্রে আর ঘুম হলো না ঠিক করে, জেগে থাকলাম - বাবা-মা শুয়ে পড়ার পর বাগানের জবা গাছটার তলায় দাঁড়িয়ে একটা ফ্লেক খেয়ে ফেললাম সাহস করে, অনেক অনেক ভাবলাম - তাকে কি লেখা যায়, যাকে আমি হয়তো এই একবারই কিছু বলবো? অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে যেন নিজেরই ভিতরে নামছি মনে হলো, কিন্তু কই টর্চ নিয়ে পাশে দাঁড়ালেন না তো রবি ঠাকুর ! -- অনেক ভেবে ভেবে সেই রাত্রে দুটো লাইন লিখলাম আমার বেনামী প্রেমপত্রের জন্যঃ  

"বৃষ্টি, কি নামে ডাকলে তোমায়,
ঝরে পড়বে আমার ঘরে, 
এই এখানে, এই এখন-ই?"

নাঃ, সন্দীপ আর অমৃতার বিয়ে হয়নি, ওরা একে অন্যজনকে নিশ্চয়ই অ্যাদ্দিনে ভুলেও গেছে, আমার-ই বা কি মনে আছে আর? সেই চিঠিটা গন্তব্যে যে পৌঁছেছিলো তা জানি, আর আমি সেই নেভিকাটের প্যাকেট-টাও একবিকেলে ছুটির বৈঠকের মাঠে দেদার উড়িয়ে দিয়েছি দখিনা হাওয়ায়, যে বিকেলে ওরা ঘুরতে গেছিলো ময়দানে ... তারপর কত গল্প আসে, কত বিকেল যায়, ছুটির বৈঠক থেকে সিগারেটদের ঠিকানা হয় প্রথমে হোস্টেলের ঘর, তারপর আর্ধেক পৃথিবী দূরে একটা বরফ-ঢাকা শহর,  তারপর তারাও হারিয়ে যায় ... এখন কেউ জানে না কে কোথায়, সত্যি বলতে কি, সেই সুভাষদা কি বেঁচে আছেন এখনো? তাও জানার সুসময় আসেনি ... তবে যে কৈফিয়ত দিয়ে শুরু করেছিলাম সেটাই আবার দিই, ওই শুকনো পেঁয়াজের খোসার মতন এই একটা-দুটো লাইন কোথায় যেন লেগে ছিলো, আজ ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলাম এক্কেরে ...